চলমান পরিস্থিতিতে প্রতিমুহূর্তেই খারাপ অবস্থার দিকে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জের পরিস্থিতি। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় জেলায় নতুন করে ১৬ নিয়ে সর্বমোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৫ জনে। মৃতের সংখ্যা ৯ জন। আইইডিসিআরও বলছে, ‘নারায়ণগঞ্জ করোনার গুচ্ছ’।
অন্যান্য জেলাতেও আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে এই জেলা। এখান থেকে অন্যকোনো জেলাতে কেউ গেলেই মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক। সৃষ্টি হচ্ছে চাঞ্চল্য। দৌঁড়ে আসছে স্বাস্থ্য বিভাগ। সংগ্রহ করা হচ্ছে নমুনা। পাঠানো হচ্ছে কোয়ারেন্টাইনে।
এই যখন সার্বিক অবস্থা তখন মাঠে নেই নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী দুইজন জনপ্রতিনিধি। এদের একজন সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী অপরজন সাংসদ শামীম ওসমান। তবে, তারা দুজন মাঠে না নামলেও আলোচনায় আছেন। সমালোচনাও রয়েছেন বেশ দারুণ ভাবে। প্রতিদিনই হচ্ছেন সংবাদ শিরোনাম। একেক জনের একক বার্তা পাওয়া যাচ্ছে সংবাদে, শিরোনামে, ফেসবুকে! আর এসব তুলে ধরছেন তাদের স্ব স্ব বলয়ের ব্যক্তিগত কিছু লোক বা স্বার্থান্বেষী।
তবে, কার্যত তারা দুজনের একজনও নেই সাধারণ মানুষের মাঝে। কি হচ্ছে, কোন পরিস্থিতিতে রয়েছে তাদের এলাকার ভোটার, মানুষেরা, তা অবলোকন করতে একদিনও নামেননি মাঠে। রহয়তো করোনার ভয় তাদেরকেও পেয়ে বসেছে। হয়তো এজন্যই তারা মানুষগুলো অবস্থা, দুর্দশার বাস্তবিক কোনো চিত্রই দেখছেন না, জানছেন না।
ওই দুই জনপ্রতিনিধি নিজ নিজ অবস্থানে তুমুল জনপ্রিয়। তাদের কর্মী সমর্থকও রয়েছে অজস্র। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই সমর্থক বা কর্মীদের মধ্যেই বা কতজনের খবর নিচ্ছেন তারা! চলমান এই অবস্থায় তাদের ভোটররা বা তাদের এলাকার মানুষগুলো কীভাবে আছে, সে খবর কি তারা নিচ্ছেন? একদমই না। যদি নিতেন তাহলে করোনায় প্রাণ হারানো শ্রমিক লীগ নেতার ছেলে ছাত্রলীগ নেতা নিজের এবং পরিবারের চিকিৎসার জন্য কোথাও কোনো সাহায্য না পেয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতেন না। এই চিত্রটা তাদের দুজনকে কতটা কষ্ট দিবে জানি না, তবে ইতোমধ্যে ছাত্রলীগের ওই নেতার স্ট্যাটাসটা হাজারও মানুষের মুখের বাণী আর চাপা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, তা অনুমেয়।
আমাদের নারায়ণগঞ্জকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন ওই দুই জনপ্রতিনিধি। কেউ কেউ এমনও স্বপ্ন দেখিয়েছেন, মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরকেও হার মানাবে নারায়ণগঞ্জ, এমন ভাবে তিনি জেলাটাকে সাজাতে চান! আবার আরেকজন সকল ধরণের অন্যায়, অনিয়মের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন এবং সোচ্চার থাকবেন বলেও বিভিন্ন সময় ঘোষণা দিয়ে আসছিলেন। অথচ সেই তারাই চলমান পরিস্থিতিতে মাঠে নেই। কি আশ্চর্য! এই তারা স্বপ্ন দেখান! নীতিবাক্য আউড়ান! আর আমরা নাদানের দলেরা সেসব গোগরাসে গিলে খাই, বগল বাজাই।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের বর্তমান যে অবকাঠামো তা অত্যন্ত নাজুক। এই নাজুক অবস্থা নিয়ে এই প্রশাসন জেলাবাসীকে কতটা সুরক্ষিত করতে পারবে, সে নিয়ে ইতোমধ্যে সন্দেহ দানা বেঁধেছে মানুষের মাঝে। প্রশাসনের অব্যবস্থাপনায় ত্রাণের জন্য এখানে হাহাকার, এমন পরিস্থিতিতেও বিক্ষোভ হচ্ছে। চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে না মানুষ। যতটুকু ত্রাণ দেয়া হচ্ছে তা মুখ দেখে দেখে দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করছে অনেকে। চেয়ারম্যানরা নামছে না, মেম্বারদেরও পাওয়া যাচ্ছে না। হাতে গোণা দু একজন কাউন্সিলরকে পাওয়া গেলেও অধিকাংশ কাউন্সিলরই রয়েছেন নিজেদের মত করে সেইফজোনে!
জেলা প্রশাসক কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। সিভিল সার্জনও রয়েছেন একই অবস্থাতে। করোনা ফোকাল পার্সন আক্রান্ত হয়ে আইসোলেশনে। প্রশাসনের কেউ কেউ রয়েছেন শোঅফ নিয়ে ব্যস্ত। নিজ ঢোল পিটিয়ে চলেছেন। চাটুকার বেষ্টিত হয়ে আছেন। চাটুকারদের এই বেষ্টনি ভেঁদ করে তাদের কাছে পৌঁছাতে পারেনা অর্ধহারে, অনাহারে থাকা মানুষেরা। প্রথম আলোর নারায়ণগঞ্জ সংবাদদাতা গোলাম রাব্বানি শিমুল একটি ভিডিও অপালোড করেছে তার ফেসবুকে। সেখানে একজন রিকশা চালকের মুখের বর্ণনা এই শহরের হাজার মানুষের কথা, অভিযোগ, ক্ষোভ, অভিমাণের চিত্র ফুটে উঠেছে।
পুলিশ প্রশাসন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখনও রয়েছে মাঠে। ৯০ লাখ লোকের এই নারায়ণগঞ্জকে সামলানো চেষ্টা করছে মাত্র দুই হাজার দুইশ পুলিশ সদস্য। তাদের পাশে আছেন কিছু সংখ্যক র্যাব সদস্য। সেনাবাহিনীও রয়েছেন। তবে, নির্বাহী বিভাগ ছাড়া সেনাবাহিনী এখানকার কোনো কিছুই বুঝে উঠবেন না। আর সেই নির্বাহী বিভাগের কর্তারা কি করছেন, সে প্রশ্ন তোলাই যেতে পারে।
কোথাও করোনা উপসর্গ নিয়ে কেউ মারা গেলে ওই যে ২২শ পুলিশ, তাদের মধ্য থেকেই একটি দল দৌঁড়ে যাচ্ছেন। কোথাও মারামারি হচ্ছে, এই তারাই যাচ্ছেন। কাউকে হাসপাতালে নিতে হবে, এই তারাই যাচ্ছেন। আর অল্প হোক, বেশি হোক, প্রথম যোদ্ধা হিসেবে পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সেবা দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে অবস্থান করছেন চিকিৎসক, সেবিকারা। পুলিশ সদস্যরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। দিনরাত এক করে কাজ করে যাচ্ছে। নির্বাহী বিভাগকে এক্ষেত্রে পাওয়া যাচ্ছে না নিজ অবস্থানে, নিজ দায়িত্বে।
একজন সংবাদ কর্মী হিসেবে ৯ এপ্রিল নির্বাহী বিভাগের একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ইউএনও, সিভিল সার্জনকে অসংখ্যবার কল করে, মেসেজ পাঠিয়ে, অপেক্ষা করেও কথা বলতে পারিনি এই আমিও। তাহলে সাধারণ একজন মানুষের অবস্থা কী হতে পারে, কেমন চিত্র হতে পারে, তা অনুমান করতে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী, বিজ্ঞানী হতে হবে না। শুধু তাদের কথাই বা বলি কেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, সাংসদ শামীম ওসমানকেও একই কায়দায় ফোন ও মেসেজ দিয়ে কথা বলতে পারিনি। তারা ফোনটি রিসিভও করেননি!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই কথাটুকু আপনাকে বলছি। নারায়ণগঞ্জের দিকে আপনাকেই নজর দিতে হবে, নয়তো এখানকার যে পরিস্থিতি তা সামাল দেয়া কষ্টকর হয়ে যাবে। এখান থেকে বিভিন্ন জেলাতে করোনা সংক্রমণ হতে শুরু করেছে। আপনি যাদের উপর ভরসা করছেন, তারা এখানে প্রকৃতভাবে কাজ করেনি। সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সময় মত। যার কারণে এখানকার অবস্থা এতটা নাজুক হয়ে যাচ্ছে। আপনার জনপ্রতিনিধিরাও নেই। দলীয় নেতারাও নেই। এখানকার বাস্তব চিত্র যদি আপনাকে জানতে হয় তবে, বিশ্বস্ত লোক প্রেরণ করে, সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে, চিকিৎসা অবস্থার খোঁজ খবর নিতে বলুন, বিশ্বাস করি, তখন আপনি নিজেও হতবাক হবেন। এই দেশটা আমাদের সবার। এই শহরটা আমাদের। একটা কথাই বিশ্বাস করি, মানি, নগর পুড়লে দেবালয় কখনও এড়ায় না।
বিঃ দ্রঃ কাউকে ব্যক্তিগত আঘাত করার জন্য এই লেখার উদ্দেশ্য বিন্দুমাত্রও নেই
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। নারায়ণগঞ্জ টুডে-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য নারায়ণগঞ্জ টুডে কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।
আপনার মতামত লিখুন :