প্রশ্ন হতে পারে ১০০ মাস আবার হিসেব হয় নাকি! হাঁ হয়, ত্বকীর বেলায় হয়েছে। ২০১৩ সালের ৬ মার্চ ত্বকী হত্যার পর থেকে প্রতি মাসের ৮ তারিখ লাশ উদ্ধারের দিনটিকে কেন্দ্র করে বিচারের দাবিতে আলোকপ্রজ¦লন সহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। আজকে ১০০ মাস পূর্ণ হচ্ছে। ত্বকী হত্যা ও বিচারহীনতার ১০০ মাস।
৬ মার্চ ২০১৩ বিকেলে সুধীজন পাঠাগারে যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সড়ক থেকে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে অপহরণ করা হয়েছিল। এর দু’দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর খালের পার থেকে পুলিশ ত্বকীর লাশ উদ্ধার করে। পুলিশ মামলাটির তদন্ত শুরু করে আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায়, ২৮ মে ২০১৩ উচ্চ-আদালতের নির্দেশে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব) এর তদন্তভার গ্রহণ করে।
সে বছর ২৯ জুলাই ইউসুফ হোসেন লিটন নামে এক ঘাতক এবং ১২ নভেম্বর সুলতান শওকত ভ্রমর নামে অপর এক ঘাতক আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তারা জবানবন্দিতে ত্বকীকে কখন, কী ভাবে, কোথায়, কারা কারা এবং কেন হত্যা করেছে তার বিশদ বর্ননা দেয়। তাদের বর্ননা অনুযায়ি অপহরণের রাতেই তারা তৎকালীন সাংসদ নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানের উইনার ফ্যাশন খ্যাত টর্চার সেলে নিয়ে ত্বকীকে প্রথমে গজারির লাঠি দিয়ে পিটিয়ে অজ্ঞান করে এবং পরে কালাম সিকদার নামের একজন তার বুকের উপর উঠে গলা চেপে শ্বাস রোধ করে হত্যা করে। রাত ১১টার মধ্যেই তারা ত্বকীর মৃত্যু নিশ্চিৎ করে এবং পরে আজমেরী ওসমানের গাড়িতে করেই তারা ত্বকীর লাশ শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে নিয়ে যায় এবং লাশ নৌকায় করে নিয়ে নদীতে ফেলে দেয়। প্রথম জবানবন্দি গ্রহণের কিছুদিন পর ৭ আগষ্ট র্যাব আজমেরী ওসমানের উইনার ফ্যাশনে অভিযান পরিচালনা করে। সেখানে তারা দেয়ালে ও আসবাব পত্রে গুলির চিহ্ন দেখতে পান এবং সেখান থেকে রক্তমাখা প্যান্ট, দড়ি, রক্তমাখা গজারির লাঠি, ইয়াবা সেবনের সরঞ্জামাদি, পিস্তলের অংশ সহ বিভিন্ন বস্তু আলামত হিসেবে সংগ্রহ করেন।
ত্বকী হত্যার ১ বছরের মাথায় ৫ মার্চ ২০১৪ র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল হাসান র্যাবের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমকে ত্বকী হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি জানান। তারা কখন, কেথায়, কী ভাবে, কেন এবং কে কে ত্বকীকে হত্যায় অংশ নিয়েছে তার বিষদ বর্ননা দিয়ে তৈরী করা একটি অভিযোগপত্র উপস্থিত সাংবাদিকদের সরবরাহ করেন। তারা জানান আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে, তারই উইনার ফ্যাশনে ১১ জন মিলে ত্বকীকে হত্যা করেছে। সংবাদ সম্মেলনের সে সংবাদ সে দিন বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল প্রচার করে এবং পরদিন তা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। র্যাব তখন অচিরেই এ অভিযোগপত্র আদালতে পেশকরা হবে বলে জানান। কিন্তু ৩০ এপ্রিল ২০১৪ সাংসদ নাসিম ওসমানের মৃত্যুর পর ৩ জুন ২০১৪ জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী ওসমান পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতির কথা জানালে; এর পর থেকেই কার্যত ত্বকী হত্যা-মামলার সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। অদ্যাবধি তৈরী করে রাখা সে অভিযোগপত্র আদালতে পেশ করা হয় নাই। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়া একজন ছাড়া অভিযুক্ত সকলেই উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে কেউ বিদেশে পালিয়ে গেছে, কেউবা দেশেই ঘুড়ে বেড়াচ্ছে।
ত্বকী হত্যার বিচারের দাবিতে বিশ্বের ১৯ টি দেশে বিভিন্ন সময় প্রতিবাদ হয়েছে। এ বিচারের দাবিতে টানা প্রায় সাড়ে আট বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন, আলোকপ্রজ্বালন, গোলটেবিলবৈঠক, প্রতীক অনশন সহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। গঠিত হয়েছে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ। দেশের লেখক, শিল্পী, বিুদ্ধিজীবীগণ প্রতিনিয়ত লেখালেখি, কবিতা রচনা, ছবি আাঁকা, গান রচনা, প্রমাণ্যচিত্র নির্মাণ, স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ, গান ও আবৃত্তির সিডি প্রকাশ সহ বিভিন্ন ভাবে এ হত্যার বিচার চেয়ে আসছেন। প্রতি বছর জাতীয় ভাবে আয়োজিত হচ্ছে রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। যেখানে অংশ নিচ্ছে দেশের অসংখ্য শিশু-কিশোর-তরুণ। ২০১৩ সালের ৮ মার্চ ত্বকীর লাশ পাওয়ার তারিখটিকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ ১০০ মাস ধরে টানা প্রতি মাসের ৮ তারিখ আলোকপ্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করে আসছে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট। কোন হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে এভাবে টানা আন্দোলন- দেশে সহ বিশ্বে কতটা নজির রয়েছে আমাদের জানা নেই।
দেশের প্রতিটি নাগরিকের বিচার পাওয়ার অধিকারকে সাংবিধান নিশ্চিৎ করেছে। দেশে কোন অপরাধ সংঘটিত হলে ৬০ দিনের মধ্যে তার অভিযোগপত্র আদালতে পেশ করার সাংবিধানিক বাধ্যবাদকতা থাকলেও প্রায় সাড়ে ৮ বছরেও ত্বকী হত্যার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয়া হয় নাই। অথচ সাড়ে ৭ বছর আগে তা তৈরী করে রাখা হয়েছে। আজকে রাষ্ট্রে সংগঠিত বিভিন্ন ঘটনাবলীর মধ্যদিয়ে বিচারিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির নগ্ন বহিপ্রকাশ পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাষ্ট্রে সংগঠিত বিভিন্ন ঘটনাবলীর কারণে আমরা মনে করতে বাধ্য হচ্ছি যে, সরকার তার রাজনৈতিক প্রয়োজনে কোন কোন বিচার সম্পন্ন করলেও রাজনৈতিক প্রয়োজনেই বহু অপরাধের বিচার-কার্য সম্পূর্ণ বন্ধ করে রাখে। সরকারের এ অবস্থানের কারণে আজকে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অবিশ^াস ও নানাহ প্রশ্ন তৈরী হয়েছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে রাষ্ট্রের এ শক্তিশালী স্তম্ভটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। বিচার ব্যবস্থা ও সুশাসন ধ্বংস হয়ে গেলে রাষ্ট্রের আর গণতান্ত্রিক চরিত্র অবশিষ্ট থাকে না; রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে আমরা দেউলিয়া দেখতে চাই না। আর চাইনা বলেই আর বিলম্ব না করে ত্বকী হত্যার অভিযোগপত্র দ্রুত আদালতে জমা দিয়ে সকল ঘাতকদের ও হত্যার নির্দেশদাতাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। রফিউর রাব্বি : তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর বাবা
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। নারায়ণগঞ্জ টুডে-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য নারায়ণগঞ্জ টুডে কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।
আপনার মতামত লিখুন :