NarayanganjToday

আনু মুহাম্মদ

অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব বিদ্যালয়

আনু মুহাম্মদ, (জন্ম: ২২ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬) পুরো নাম আনু মুহাম্মদ আনিসুর রহমান হলেও আনু মুহাম্মদ নামেই অধিক পরিচিত, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক। বর্তমানে তিনি তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব। বাংলাদেশে মার্কসীয় অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অর্থনীতি সংক্রান্ত আলোচনায় তিনি সবচেয়ে পরিচিত লেখক।

ত্বকীর সাথে অসংখ্য মুখ


আনু মুহাম্মদ : অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, নয় বছর পূর্ণ হলেও তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার কোনো বিচার এখনও হয়নি। এই নয়বছরে দেশে খুন গুম নিপীড়ন ও অকাল মৃত্যুর মিছিল দেখলে ত্বকী হত্যার বিচার না হওয়া আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হবে না। এপর্যন্ত এরকম ঘটনা খুঁজে পাওয়া মুশকিল যেখানে খুনি সরকারি দলের ক্ষমতার আশির্বাদপুষ্ট আর তার বিচার হয়েছে। বিশ্বজিৎ বা জোবায়ের হত্যাকা- নিয়ে অনেক তোলপাড় হবার কারণে বিচার হয়েছিল, রায়ও হয়েছে কিন্তু দন্ডপ্রাপ্ত মূল আসামিরা পলাতক থেকে যেতে পেরেছে। সাগর-রুনির তদন্তকাজই শেষ হয়নি। তনু হত্যার ক্ষেত্রেও তাই। তবে ত্বকীর ক্ষেত্রেও প্রবল আন্দোলনের চাপে তদন্ত অনেকদূর ভালোভাবেই অগ্রসর হয়েছিল। তখন মামলার তদন্তকারী সংস্থা ছিল র‌্যাব, হত্যাকা-ের এক বছর পূর্তি হবার আগেই তারা ত্বকী হত্যা কেন, কখন, কোথায়, কীভাবে সংঘটিত হয়েছে, কারা করেছে তার প্রাপ্ত তথ্যাবলী সংবাদ সম্মেলন করে জানায়। র‌্যাব কর্মকর্তারা তখন একটি খসড়া অভিযোগপত্র উপস্থাপন করে সংবাদকর্মীদের জানান যে অচিরেই অভিযোগপত্রটি আদালতে পেশ করা হবে। কিন্তু তারপর থেকেই পুরো প্রক্রিয়া থমকে যায়। প্রধানমন্ত্রী সংসদে শামীম ওসমান পরিবারের পক্ষে জোর দিয়ে কথা বলার পর আর কোনো কাজ হয়নি। সে অভিযোগপত্র আজও আদালতে পেশ করা হয় নি।

ত্বকীর জীবন মাত্র শুরু হবার পথে ছিল, তখনই তাকে খুন করেছে দুর্বৃত্তরা। বাংলাদেশে এমনিতে অকাল মৃত্যুর শেষ নেই। এই অকালমৃত্যুর বহু ধরন, শিশু-তরুণ-নারী-পুরুষ, জবাবদিহি করার কেউ নেই। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের কথিত মালিক জনগণের এতিম অবস্থা। জনগণের ওপর খবরদারি করা আর তাদের জীবন অতীষ্ট করায় ক্ষমতাবানদের বহু শাখা প্রশাখা আছে। তাদের কাছ থেকে কর আদায়ে, করসহ গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়াতে সরকারের প্রবল আগ্রহ, ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে সবরকম প্রতিবাদ সমালোচনার পথ বন্ধ করতে সরকার সদা সক্রিয়। কিন্তু জনগণের বাঁচামরা নিয়ে সরকার কোনো দায় বোধ করে না।

আমরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র দেখেছি, পাকিস্তানি প্রায় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র দেখেছি। উপনিবেশকালের এসব রাষ্ট্রের সাথে বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্রের তফাৎ কী? ঔপনিবেশিক প্রভুদের মতোই দেশি শাসকেরা, তাদের অর্থবিত্ত ক্ষমতার উৎস এই পোড়া দেশ কিন্তু তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ঠিকানা অন্যত্র। সড়ক দুর্ঘটনাতেই বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫ থেকে ৭ হাজার মানুষ নিহত হচ্ছে, জখম বা পঙ্গু হচ্ছে কতো তার হিসাব নেই। এর প্রতিকারে রাষ্ট্রের কোনো উদ্যোগ নেই। বরং গুম ক্রসফায়ারে দুই সহস্্রাধিক মানুষকে খুন করেছে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী। আদালত শুধু তাই দেখে যা দেখতে সরকার আপত্তি করে না। কারাগারে বিনা বিচারে এমনকি বিনা অপরাধে আটকে থাকে হাজার হাজার মানুষ বছরের পর বছর। অচল গাড়ি ফিটনেস কাগজ দিয়ে, বেআইনী ভবন অনুমতি দিয়ে, নদী-বন দখলদার, পানি বায়ু বিষাক্তকারীদের রক্ষা করে, সরকারি বিভিন্ন বিভাগ দেশের মানুষদের অস্বাভাবিক অকাল মৃত্যু আর দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার পথ তৈরি করে।

একটা বিষয় এতদিনে সবার কাছে পরিষ্কার হবার কথা যে, কোনো অপরাধের বিচারে যদি শ্লথগতি বা টালবাহানা দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে খুনি বা অপরাধীকে যে কোনোভাবে রক্ষা করাই সরকারি সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তটাই আসল, বাকি সবই সাজানো খেলা। তবুও আইন আদালত, নানা বাহিনীর রঙিন আয়োজন, সরকারি উদাত্ত প্রতিশ্রুতিতে মানুষ বারবার বিশ^াস করতে চায়, বারবার তার বিশ্বাস ভঙ্গ হয়।

ত্বকী কিশোর বয়সেই সমাজের এই দস্যুদের সনাক্ত করেছিল  তার কবিতায়, আবার স্বপ্নও দেখেছিল বাংলাদেশ আবার জেগে উঠবে, মানুষ আবার এই দস্যুদের পরাজিত করবে। ত্বকী খুন হয়েছে তার ভেতরের এই শক্তির জন্যই। সন্ত্রাসী দখলদারদের হাতে বিপর্যস্ত একটি জনপদে মানুষের পক্ষে লড়ছিলেন তার বাবা ও স্বজনেরা। ত্বকীকে খুন করে তারা শুধু একটি সৃজনশীল প্রাণকে স্তব্ধ করতে চায়নি, স্তব্ধ করতে চেয়েছিল জনগণের সেই শক্তিকে যার ভয়ে তারা বরাবর সন্ত্রস্ত থাকে। সার কথা এই যে, ত্বকীকে নির্মমভাবে খুন করার পরেও পরাজিত হয়নি জনগণের সেই শক্তি। বরং আরও অপ্রতিরোধ্য হয়েছে। ত্বকীর কথা বলতে গেলে ভিআইপি দস্যুদের কথা আসে, আসে তাদের লোভে আগ্রাসনে ক্ষতবিক্ষত অসংখ্য মানুষের কথা, আসে সুন্দরবনের কথা, হারিয়ে যাওয়া বা মরতে বসা নদীর কথা, আসে বাংলাদেশের মলিন মুখের কথা। সে জন্যই ত্বকী একা নয়, তার হত্যার বিচারের লড়াই শুধু এক কিশোরের জীবননাশের বিষয় নয়, ত্বকী এখন সমগ্র বাংলাদেশকে মানুষের হাতে ফিরিয়ে আনার প্রশ্নের সাথে জড়ানো। সেজন্যই ত্বকী হত্যার বিচার হবেই, জনগণের শক্তিই তার খুনি আর খুনিদের পৃষ্ঠপোষকদের বিচার করবে।

প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। নারায়ণগঞ্জ টুডে-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য নারায়ণগঞ্জ টুডে কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

উপরে