NarayanganjToday

শিরোনাম

লাল-নীল সংসার-২০

ফেরদৌস কান্তা


লাল-নীল সংসার-২০

গেইটের বাইরে বেরুতেই রিপন দৌঁড়ে এলো জাহিদের কাছে। নাকে-মুখে প্রশ্ন করা শুরু করলো, ‘তুই ঠিক আছিস? নিরুকে পেলি? ওর সাথে কথা হয়েছে? আমি এদিকে টেনশনে শেষ’। ‘আরে থাম, থাম। এতো কিছু একসাথে কিভাবে জবাব দিবো’? এটা বলার সাথে সাথেই রিপন জোরে ঝাপটে ধরল জাহিদকে। বলল, ‘ঠিক আছে কিছুই বলা লাগবেনা না এখন। কিছু খেয়ে নিই আগে, চল। জব্বর খিদা পেয়েছে। তোর জন্য অপেক্ষায় থেকে থেকে আমিও কিছুই খাইনি এখন পর্যন্ত, টেনশনে শুধুই চা নিলাম মনে হয় বিশ পঁচিশ কাপ। খেতে খেতেই আলাপ হবে’।

দু’বন্ধু মিলে একটা হোটেলে খেতে ঢুকল। খেতে বসে ওরা টের পেলো জব্বর খিদা পেয়েছিলো দু’জনেরই। আলাপ করতে করতে খাওয়া সেরে নিলো ওরা। জাহিদ একে একে জানালো ভেতরে কি হয়েছে। নিরুর সাথে দেখা হল না বলে অনেক মন খারাপ নিয়ে কথা শেষ করলো।

রিপন বলল, ‘শেফালি মেয়েটি কম বয়সি হলেও বেশ বুদ্ধিমতী। মেয়েটি তোকে ঠিক উপদেশই দিয়েছে। তাড়াহুড়া করলে তোর ক্ষতি হবে আবার নিরুকেও বের করা যাবেনা। এখন আমাদের খুব ভেবে-চিন্তে সামনে আগাতে হবে। ওদের বুঝতে দেয়া যাবেনা যে তুই কারো খোঁজে ভেতরে গেছিস। দুই-চার দিন কাস্টমার সেজে থাক, ভেতরে যা, নিরুর সাথে যোগাযোগ করে কথা বল আগে। তারপর আমরা ঠিক করবো কিভাবে সামনে আগাবো’। জাহিদ আনমনে মাথা নেড়ে বলল, ‘হু’। খাবারের বিল পরিশোধ করে দু’বন্ধু বাইরে বের হলো হোটেল থেকে।

পরদিন বেশ সকাল সকালই জাহিদ এসে পৌঁছে গেলো সেখানে। সারারাত ভালো করে ঘুমাতেও পারেনি সে। পুরাটা রাত অস্থিরতায় কেটেছে। আজ রিপনকে সাথে আনেনি। রিপন গেছে পরিচিত এক বড় ভাইয়ের কাছে যিনি ডিবি পুলিশে আছেন বলে ওরা খোঁজ পেয়েছে। আপাতত উনার কাছেই সাহায্য চাইবে বলে ওরা ঠিক করেছে। আর এদিকে জাহিদ নিরুর সাথে দেখা করে আগে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করবে। যথারীতি ভেতরে গিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা মতো শেফালিকে চাইলো। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল চার-পাঁচজন বিভিন্ন বয়সী মেয়ে। সবাই বিকট স্বরে জাহিদ শেফালিকে চাইলো বলে হেসে উঠলো। একজন টিপ্পনি কেটে বলল, ‘আমরা শেফালির চেয়ে ভালা পারি, আমাগোরেও সুযোগ দেন।’ এই কথা শুনে বাকিরাও আরও জোরে হেসে উঠলো। জাহিদের শরীর খারাপ লাগতে শুরু করেছে, মনে হচ্ছিলো বমি করে দিবে সে। বেশ কিছুক্ষণ পর একজন মহিলা এসে বলল, ‘শেফালি আজ পারবেনা, তার বদলে চম্পাকে দিয়েছি। চম্পা একেবারেই নতুন, শেফালির চেয়েও ছোট, আসেন’। একথা শুনার পর কেন জানি জাহিদের সারা শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো!

অনেকক্ষণ ধরে জাহিদ তাকিয়ে আছে নিরুর দিকে। নিরু তার সামনে বসে আছে প্রায় ঘণ্টাখানেক হয়ে গেছে। জাহিদের মুখে কোনো কথাই আসছে না কেন জানি! সে শুধু অবাক হয়ে তাকিয়েই আছে নিরুর দিকে আর নিরু চোখ-মুখ শক্ত করে তার সামনে বসে আছে মাটির দিকে তাকিয়ে। ফোন ভাইব্রেট হতেই সম্বিৎ ফিরে পেলো যেন জাহিদ, ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখল রিপনের ফোন। কেটে দিয়ে ম্যাসেজ দিলো, ‘আসছি’। বুঝল এতক্ষণ অহেতুক সময় নষ্ট করেছে সে। প্রতিটা মূহুর্তই মুল্যবান যেখানে, সেখানে এভাবে সময় নষ্টের কোনো মানে হয়না। তারপর নিরুর কাছে চলে গেলো। আস্তে আস্তে নিরুর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘নিরু, আমি জাহিদ, আমাকে চিনেছ? আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি এখান থেকে’।

এতো কিছু বলার পরও নিরুর ভেতর কোন ভাবান্তর দেখা গেলো না। জাহিদ আবারও বলল, ‘নিরু, নিরু, আমার দিকে তাকাও, আমি জাহিদ, তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি এখান থেকে’। নিরুর চোখের পাতা সামান্য কেঁপে উঠলো যেন! কিন্তু ঠায় বসে থাকা নিরুর ভেতর কোন পরিবর্তন দেখা গেলো না। জাহিদ অধৈর‌্য হয়ে নিরুকে ঝাঁকাতে লাগলো আর বলতে লাগলো, ‘নিরু আমি জাহিদ, তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি এখান থেকে’।

জাহিদের মনে হচ্ছিলো সারা দুনিয়া এখানেই আটকে গেছে যেন! হঠাৎ দেখল নিরু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। জোরে বুকে টেনে নিয়ে নিরুকে বুকের সাথে চেপে ধরল জাহিদ। তারপর নিজেও ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো নিরুর সাথে। দরজায় ধাক্কার শব্দে হুঁশ এলো জাহিদের। নিরুকে বসিয়ে রেখে, চোখ ভালো করে মুছে নিয়ে দরজা খুলে মানিব্যাগ বের করে কিছু টাকা দরজায় দাঁড়ানো মহিলাটাকে দিলো, সাথে এও জানালো ওর আরও সময় লাগবে। টাকা নিয়ে চলে গেলো মহিলা। ফিরে এসে নিরুর চোখ মুছিয়ে দিল সে। তারপর ধীরে ধীরে জানালো, এখানে কিভাবে এসে পৌঁছেছে নিরুকে খুঁজতে খুঁজতে। আর এখান থেকে ওকে না নিয়ে ফিরে যাবেনা তাও জানালো। নিরু কেঁদেই যাচ্ছে। কোনো কথাই তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছেনা। জাহিদের নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হতে লাগলো। নিরুর হাত দুটি নিজের হাতে নিয়ে বলল, ‘ আমি যদি মরেও যাই, যাবো। তবে তুমি এখান থেকে ঠিকই বের হয়ে বাড়ি ফিরবে। কথা দিলাম তোমাকে। শুধু কয়টা দিন সময় দাও। আর কয়টা দিনই তোমাকে এখানে থাকা লাগবে। তারপরই একেবারেই তোমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবো আমি। সবার কাছে সাহায্য চাইছি। আশা করি কোনো না কোনো ব্যবস্থা খুব দ্রুত করে ফেলবো। তা যদি না পারি তবে যেভাবেই পারি তোমাকে এখান থেকে বের করবোই আমি।’

‘এরা খুব ভয়ঙ্কর মানু’ যেন বহুদূর থেকে কারো ক্লান্ত গলা ভেসে এলো, ‘এরা কথায় কথায় মানুষ মেরে ফেলে, জানতে পারলে তোমাকেও মেরে ফেলবে। তুমি কেন এসেছ এখানে’? নিরুর কথা শুনে মনটা যেন কষ্টে মুচড়ে উঠলো জাহিদের। বলল, “কেন এসেছি? এসেছি তোমার জন্য। আমার বোকামির জন্যই তোমার এই অবস্থা। তোমাকে মুক্ত করার দায়িত্ব তাই আমার। মরে গেলে যাবো মরে। আমি মরতে ভয় পাইনা। তবে তোমাকে এখান থেকে বের না করে মরবো না এটাও ঠিক”।

বারবার রিপনের ফোন আসাতে বুঝল জাহিদ আজকের মতো যাওয়া লাগবে। নিরুকে আবার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল, “ আজকে থেকে আর কারো সাথে রুমে যাবেনা। আমি টাকা দিয়ে যাব। কাল আবার আসবো। যা হয়েছে হয়ে গেছে, তা আমি ঠিক করতে হয়তো পারবোনা। কিন্তু কাল থেকে যেন তোমার আর কোনো কষ্ট না হয় তা আমি অবশ্যই ঠিক করতে পারব”। নিরুর হাত দুটি ধরে সামান্য চাপ দিয়ে আবারও বলল, “শেষবারের মতো আমার উপর ভরসা করো। তোমাকে আর কোনো নতুন কষ্ট আমি কিছুতেই পেতে দিবনা”। যেতে যেতে বলল, ‘কেউ যেন টের না পায় আমি তোমার পরিচিত। শেফালি জানে শুধু। কিছু হলে ওর সাহায্য নিও। সেই আমাকে সাহায্য করেছে। আমি কাল আবার আসবো’। (চলবে)

উপরে