প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৯, ০৮:০১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৯, ০৮:২৫ পিএম
ফারজানা আলম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৯, ০৮:২৫ পিএম
ফারজানা আলম
আপু জানো, মামনি প্রত্যেকদিন রাতে অনেক কান্না করে।মামনি ভাবে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি, কিন্তু আমি তো না ঘুমিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখি তাই মামনি বুঝতে পারে না। আমি জানি মামনি কেন কান্না করে, তুমি যে মামনির সাথে কথা বলোনা এজন্য মামনি কান্না করে। আচ্ছা আপু তুমি মামনির সাথে কথা বলোনা কেন?
–‘বলবো না, কোন দিন বলবো না, সে আমার কেউ না!’ আমি পাশে রান্নাঘরেই ছিলাম, ‘সে আমার কেউ না’ কথাটা ভেসে এসে বুকের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে মা হিসেবে নিজের ব্যর্থতার কথা সহজ করে জানিয়ে দিয়ে গেলো।
আহ, সংসার! আমি আর তায়েব একমুঠো আশা তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্ন দিয়ে সাজিয়েছিলাম সংসারটাকে। আর আমাদের সন্তান দুটো এসেছিলো সেই অধরা স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে। সবসময় মনে হয়েছে আমরা দুজন মিলে একটু একটু করে অনেক সুখ জড়ো করবো তারপর একদিন আমরা সবাই মিলে অনেক সুখী হবো।
সুখের স্বপ্নগুলো জড়ো করতে আমাদের যত সময় লেগেছিলে তার চেয়েও অনেক কম সময়ে আমদের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো অনেক দুঃস্বপ্নের।
আমি আর তায়েব ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম। আমার পরিবার পরে মেনে নিলেও তায়েবের পরিবার আমাকে মানতে পারেনি।তার পরিবার থেকে আমাকে ছাড়তে বলা হয়েছিলো, সে পারেনি বিধায় তার পরিবার তাকে ছেড়ে গিয়েছিলো!
কাছের মানুষদের দূরত্ব কষ্ট তো দিয়েছিলো, কিন্তু দুটো মানুষের একসাথে পথচলার সুখটুকও কম ছিলো না। তায়েব একটা প্রাইভেট ফার্ম-এ জব করতো, সেটা দিয়ে আমাদের সংসার ঠিকঠাক মতো চলে যেতো। হ্যাঁ কখনো বিলাসিতা করতে পারিনি আমরা। তবে আমাদের নির্ভেজাল সুখ সেই আফসোসটা কাটিয়ে দিতো। আর আমাদের সন্তানদের হাসিমাখা মুখের দিকে যখন তাকাতাম তখন মনে হতো বাহ, জীবন অনেক সুন্দর।
বিপত্তি ঘটলো তখন, যখন তায়েব যে ফার্মটাতে জব করতো সেটা বন্ধ হয়ে গেলো। হঠাৎ যেন আমরা মাঝ সমুদ্রে পড়ে গেলাম, আর সেখান থেকে পাড়ে উঠার উপায় আমাদের জানা নেই। তায়েব অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারছিলো না। একদিন তায়েব বললো, তার এক কলিগ বিদেশ চলে যাচ্ছে, আর আফসোস করলো কিছু টাকা থাকলে হয়ত সেও চেষ্টা করতে পারতো।
‘অভাবের প্রথম কাজ হচ্ছে সে সবার আগে আত্নসম্মানকে গুড়িয়ে দিবে, তারপরেও যদি অভাব শেষ না হয় তাহলে আস্তে আস্তে অন্যান্য অনৈতিকতার দিকে অগ্রসর হবে!’ আমার ক্ষেত্রেও তাই হলো। বাবা মায়ের কাছে হাত পাতলাম, কান্নাকাটি করলাম, সম্পর্কের দোহাই দিলাম যার বিনিময়ে কয়েক লাখ টাকা পেলাম যা দিয়ে তায়েব বিদেশে পাড়ি জমালো। খুব কষ্ট হয়েছিলো যখন তায়েব চলে যাচ্ছিলো। ছেলেমেয়ে দুটোও খুব কেদেঁছিলো। মেয়েটা কেদেঁছিলো বাবা চলে যাচ্ছে বলে আর ৩ বছরের ছেলেটা কেঁদেছিল বাবা ওকে ছাড়া একা একা প্লেনে উঠবে বলে।
প্রবাস জীবন মানেই টাকা আসলে কি তাই? ১২ ঘন্টা কাজ করে এসে ওকে নিজের জন্য রান্না করতে হতো, সব কাজ করতে হতো। একদিন তায়েব বললো, ‘বউ চোখের মনে হয় সমস্যা হইছে একটু পরপরই চোখ দিয়ে পানি পরে, তুমি আবার ভাইবো না আমি কাদিঁ। ছেলে মানুষদের কাদঁতে নেই শুধু মাঝে মাঝে বুকটা ভারী হয়ে আসে। ছেলেমেয়ে দুইটার কথা মনে পড়ে।’ আর একদিন বললো, ‘বউ জানো কালকে কাজ থেকে এসে আর রান্না করতে ইচ্ছে হয় নি, শরীরটা এতো ক্লান্ত ছিলো ঘুমিয়ে পড়ছিলাম মাঝরাতে ক্ষুধায় সজাগ হয়ে গেলাম তখন তোমার কথা খুব মনে পড়েছিলো। তুমি কোনদিন না খেয়ে রাতে ঘুমুতে দিতে না, একেবারে যখন খেতে চাইতাম না জোর করে নিজে হাতে খাইয়ে দিতে।’ আবার মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে বলতো ‘বউ তরকারিটা পুড়ে গেছে কি করি বলোতো।’
দুটো মানুষ একসাথে পাশে চলতে চলতে একজন আরেকজনকে সবসময় অনুভব করা হয়ে ওঠেনা, সেই মানুষটাই যখন চোখের আড়াল হয় তখন উপলব্ধি করা যায় মানুষটা কতটা জুড়ে আছে ফোনের এপাশে কতো রাত যে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেদেঁছি তার হিসেব নেই। তায়েব তখন বলতো ‘বউ চোখের সমস্যাটা আবার দেখা দিয়েছে কারনে অকারনেই চোখ দিয়ে পানি পরে।’ আসলে সেও ফোনের ওপাশে কাদঁতো।একদিন ফোন দিয়ে বললো ‘রেনু ভাড়ায় গাড়ি চালাবো এতো পরিশ্রমের কাজ ভালো লাগে না।’
২ বছর আগে ঠিক এমনই এক দুপুরে খবর আসলো তায়েব আর নেই! তার গাড়িটা এক্সিডেন্ট করেছে সে স্পট ডেথ। আচ্ছা ‘দুঃখের পর নাকি সুখ আসে’ তাহলে মানুষটা দুইটা বছর যে অমানবিক কষ্ট করেছে আমাদের জন্য, বিধাতা তার ভাগের সুখটুকু না বুঝিয়ে দিয়েই কিভাবে তাকে নিয়ে গেলো! সবাই বলে, ‘স্রস্টা যা করে সব ভালোর জন্যই করে’ একটা মানুষকে এমন নিষ্ঠুর মৃত্যু দিয়ে আর বাকি তিনটা জীবনকে থামিয়ে দেওয়ার মাঝে কি ভালো থাকতে পারে?
ছুটে গিয়েছিলাম শ্বশুরবাড়িতে ছেলেমেয়ে দুটোকে সাথে করে নিয়ে। নাহ, আমার দুঃখের ক্ষানিক ভাগ তাদের দিয়ে দুঃখটা কমাতে নয়! তায়েবের লাশটা আনতে হবে। গাড়ির মালিক না করে দিয়েছে সে কোন খরচ দিতে পারবে না। তার নতুন গাড়িটা নষ্ট হয়েছে সেজন্য সে তায়েবকে দায়ী করছে। আমার শ্বশুর শাশুড়ি তাদের সন্তানের লাশ আনার দায়িত্ব নিলেও আমরা তাদের কেউ না বলে তাড়িয়ে দিতে দ্বিধা করেনি। নাহ, সরাসরি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় নি, বলেছিলো তায়েবের দাফন, কাফন শেষ হয়ে গেলে যাতে আমরা চলে যাই। তবে তিনি আমাকে অভিশাপ দিতে ভুল করেন নি, আমি নাকি অলক্ষ্মী, তার ছেলেকে আমি খেয়ে ফেলেছি!
তায়েবের মারা যাওয়ার পর শুরুর কিছুদিন আমদের সহানুভূতি দেখানোর মানুষের অভাব হলো না। কাছের মানুষরা সবাই আসছিলো, আফসোস করছিলো আর আশ্বস্ত করছিলো, আমি যাতে কিছু না ভাবি তারা তো আছে। কেউ কেউ যাওয়ার সময় দায়িত্ব পালন সরূপ ৫০০, ১০০০ টাকার নোট হাতে গুজে দিয়ে যেতো। সময় যেতে লাগলো আর সহানুভূতি কমে আমরা সবার কাছে বোঝা হতে থাকলাম। এরকম না আমি কিছু করার চেষ্টা করি নি। নিয়ম করে পরিচিত মানুষদের কাছে কাজের জন্য সুপারিশ করতে লাগলাম। কেউ সরাসরি না করে দিতো, আবার কেউ চক্ষু লজ্জায় সরাসরি না করতে পারতো না, কয়েকদিন ঘুরিয়ে পরে ইনিয়েবিনিয়ে না করে দিতো।
ভাই বোনেরা শুরুতে খুব উচ্ছ্বাস আর বড় মন নিয়ে সাহায্য করলেও এরপর সরাসরি বলে দিতো ‘বুঝিস তো, আমাদের নিজেদেরও তো সংসার আছে।দেখ তুই নিজে কিছু করতে পারিস কিনা।’ আসলে তাদের দোষ নেই। নিত্যদিনের অভাব মোচনের দায়িত্ব কেউ নেয় না। আর এটাই বাস্তবতা। মানুষ এমন দয়া করতে পছন্দ করে যেটা দুই একবার করলেই শেষ হয়, সাথে সম্মানটাও বেড়ে যায়।
এমন সময়ই লোকটার চোখে পরেছিলাম আমি। পরিচিত একজনকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো। শুনেছি তার বউ তাকে ছেড়ে চলে গেছে, একটা বাচ্চা আছে। নাহ, সে তার বাচ্চার দেখাশোনা করার জন্য আমাকে বিয়ে করে নি। আসলে আমি তার বৈধ রেজিস্ট্রিকৃত পতিতা। নিয়ম করে পতিতাদের কাছে যেতে তার নাকি অরুচি হয় তাই আমাদের ভরনপোষণের বিনিময়ে সে মাঝে মাঝে এখানে রাত কাটাবে। মানুষটা ভালো না খারাপ কখনো জানতে ইচ্ছে হয় না।না সে কখনো আমার সুখ দুঃখের খবর নিয়েছে না আমি কখনো তাকে জানতে চেয়েছি। সম্পর্কটা সত্যি সত্যিই শরীরের। ছেলেটা বুঝতে পারে না বলে কিছু বলে না কিন্তু আমার ১০ বছরের মেয়েটা তার কাছে আমি পতিতা সমতুল্য। তার বাবার জায়গাটা আমি এতো সহজেই অন্যকে দিয়ে দিয়েছি সে এটা মানতে পারে না।
আচ্ছা তায়েব কি আমাকে উপর থেকে দেখে! সে কি আমাকে ঘৃনা করে? আমার মেয়েটা যেভাবে বলে ‘আমি তার কেউ না’ সেও কি এমন করে বলে ‘রেনু তুমি খুব খারাপ! তুমি আমার কেউ না!’
আপনার মতামত লিখুন :