মেয়েটি আমার পাশের বাড়ির ছিলো। বয়স কত হবে, পনের কী ষোল। ছিপছিপে গড়নের ফর্সা গোলাকার চেহেরার মেয়েটি খুব সহজেই চোখে পরার মতো । আসলেই চোখে পরার মতো তাইতো মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিলো।
আমার আর মেয়েটির বাড়ি একেবারে পাশাপাশি হওয়ার কারনে প্রায়ই ছাদে কাপড় নাড়তে গেলে তার সাথে দেখা হয়ে যেতো। সেও কাপড় শুকাতে আসতো। কেমন আছো, আর হাসি বিনিময়ের বাইরে খুব বেশি কথা হতো না। মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি বরাবরই আমার আগ্রহ কম। আমার মনে হয় ‘ব্যক্তি মানুষকে খোঁজা মানুষের ব্যক্তিগত জীবন জানার চেয়েও বেশি আনন্দের।’ তাই মানুষের স্বেচ্ছায় বলা দুই চার কথাই আমি মানুষকে খোঁজার চেষ্টা করি। মেয়েটি সম্পর্কেও তাই বেশি কিছু জানার চেষ্টা করিনি।
একদিন ছাদে দেখা হওয়ার পর মেয়েটি বললো, ‘আপু এই দুই দিন আপনি ছাদে আসেন নি কেন ? আমি আপনার অপেক্ষায় ছিলাম।’ আমি খুব অবাক হয়েছিলাম।এর পর তার সাথে আমার দেখা হলে সে প্রায়ই আলাপ জুড়ে দিতো। সেখানে থাকতো তার ব্যক্তিগত জীবনের আলাপ, আর না ছুঁতে পারা স্বপ্নের হাহাকারের প্রলাপ।
আমার খুব মায়া হতো মেয়েটির উপর। তার ভিতরে চলা তোলপাড় শব্দ অভাবে সে পুরোপুরি বর্ননা না করতে পারলেও, তার অস্পষ্ট কথাগুলো বুঝতে আমার অসুবিধা হতো না।
গরীব ঘরে সুন্দরী মেয়ে জন্ম নিলে যা হয়, বাবা মায়ের চোখে থাকে সবসময় আতংক খারাপ কিছু না ঘটে যায়! এরকম ক্ষেত্রে এদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে মেয়েকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাত্রস্থ করা।এলাকার মধ্যেই মোটামোটি এক ধনী পরিবারের চোখ পড়েছিলো মেয়েটার উপর। মেয়েটির বাবা এরকম প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে চায় নি। তবে বয়স কম বলে দুইটা বছর ছেলে পক্ষকে অপেক্ষা করতে বলেছিলো মেয়েটির বাবা।ছেলের বাবা তখন বলেছিলো ‘আপনার মেয়ে আমার বাসায় আপনার বাড়ির চেয়েও আদরে থাকবে, আপনি আর দ্বিমত কইরেন না।’ মেয়েটির বাবাও চোখ বন্ধ করে বিস্বাস করেছিলো কথাটা। তার মনে হয়েছিলো অভাবের কারনে মেয়েটাকে ছোট থেকে এই পর্যন্ত তেমন কিছুই দিতে পারিনি এবার বুঝি মেয়েটার কপাল ফিরলো। মেয়েটাকে বোঝানো হলো বিয়ে মানে শুধুমাত্র বাড়ি বদল! বাবার বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি থাকতে হবে এই যা!
মেয়েটি পড়ালেখায় ভালো ছিলো। কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করতো ‘তুমি পড়ালেখা করে কি করতে চাও?’ মেয়েটা নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারতো না। শুধু সে বলতো, সে পড়ালেখ করে বড় মানুষ হতে চায়। তার মনে হতো পড়ালেখা করলে বড় মানুষ হওয়া যায়, তখন যা ইচ্ছে করে তাই করা যায়, কেউ তখন আর কিছু করতে নিষেধ করে না।
মেয়েটির আর বড় মানুষ হয়ে ওঠা হয়নি! বিয়ের পর কয়েকদিন সে স্কুলে গিয়েছিলো। তার শ্বশুর এসে তার শাশুড়িকে বলেছিলো ‘বাড়ির বউ রাস্তা দিয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে যায়! মানসম্মান আর কিছু রইলো না।’ মানুষ নাকি দোকানে বসে হাসাহাসি করে, তাকে ডেকে বলে ‘এই যে ব্যাগ কাঁধে স্কুলে যায়, এটা আপনার ছেলের বউ না!’ এই কথা বলে তারা নাকি মুখ টিপে হাসে! তার শ্বশুর শাশুড়িকে বললো ‘বউ যেন কাল থেকে স্কুলে না যায়, বলে দিয়ো।’
মেয়েটি এই কথা শুনে খুব কষ্ট পেয়েছিলো। তার স্বামীর কাছে গিয়ে শার্টের কোনায় আংগুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে ফুপিয়ে কেদেঁ উঠেছিলো, আর বলেছিলো, ‘আপনি একটু বাবাকে বলে দেখেন না, আমি পড়তে চাই।’ তার স্বামী তখন হেসে দিয়ে বলেছিলো, ‘এতো পাগলামী করলে চলে? বিয়ে হয়েছে এখন সংসার করা শিখতে হবে, পড়ালেখা করে কি করবে? আর তুমি তো জানো, বাবার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলার সাহস আমার নেই! তুমি এটা নিয়ে আর ভেবো না।’
মেয়েটি খুব কেঁদেকেটে তার বাবা মাকেও বলেছিলো সে পড়ালেখা করতে চায়। তার বাবা তখন বলেছিলো ‘পড়ালেখার জন্য তো আর সংসার ছাড়া যাবে না, তুই স্কুল ছেড়ে দে।’ সাথেসাথে তার বাবা তাকে শাসন করেও দিয়েছিলো এটা বলে যে, পড়ালেখা করা নিয়ে সে যেন শ্বশুরবাড়িতে আর ঝামেলা না করে, অনেক কপাল গুনে তার এতো বড় বাড়িতে বিয়ে হয়েছে। এসব পাগলামী করে সে যেন নিজের কপাল নিজে মন্দ না করে। সেদিন মেয়েটি বুঝেছিলো ‘বিয়ে মানে শুধু বাড়ি বদল নয়; বিয়ে হলে জীবন ও বদলে যায়।’
একদিন উঠানে খেলতে থাকা মেয়েদের সাথে মেয়েটি কুতকুত খেলেছিলো, মেয়েটির শাশুড়ি তখন বিলাপ করে কেঁদেছিলো! তার স্বর্নের টুকরা ছেলের কপালে এই মেয়ে ছিলো! এই দুর্দিন দেখার আগে কেন আল্লাহ তাকে দুনিয়া থেকে নিয়ে গেলো না! প্রত্যেক দিনের ছোট্ট ছোট্ট ঘটনা আর বউ হিসেবে বিধিনিষেধ মেয়েটাকে আস্তে আস্তে নিরব করে দিতে লাগলো। সে নিজেও মেয়ে থেকে বাড়ির বউ হবার চেষ্টায় নেমে গেলো। তবে তার বাহিরটা নিরব হয়ে গেলেও তার ভিতরের অর্ন্তদন্দ্বটাকে সে নিরব করতে পারলো না। সে যখন তার ঝা’দের সাথে তার দুঃখগুলো বলার চেষ্টা করতো তারা পাত্তা দিতো না, হাসাহাসি করতো। আসলে তাদের দোষ ছিলো না, তাদের জীবনও ঠিক এ পথেই এগিয়েছে। তারা সহজভাবে মেনে নিয়েছে তাই তাদের জীবন সহজ। মেয়েটি মানতে পারেনি! তার স্বপনগুলো ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করতো, তার পাশে চলার মানুষটির মাঝে সে কতৃত্বকারী স্বামী নয় বরং বিশ্বস্ত বন্ধু খোঁজতো, যার কাছে অবলিলায় তার সব ইচ্ছের কথা বলা যায়। নিত্যদিনের নিয়ম করা জীবন থেকে তার মাঝেমাঝে পালিয়ে বেড়াতে ইচ্ছে করতো।
কোন একদিন মাঝরাতে চিৎকার শুনে জেগে উঠেছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম মেয়েটার শ্বশুর অসুস্থ, হয়ত তার কিছু হয়েছে। তবে আমার ভুল ভাঙ্গতে দেরী হলো না, যখন মেয়েটির নাম ধরে সবাই বিলাপ করতে থাকলো! মেয়েটি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্নহত্যা করেছিলো! কেউ আফসোস করছিল এতো সুন্দর পরিপাটি সংসার ছেড়ে এই কাজটা করলো বলে, আবার কেউ ধিক্কার দিচ্ছিলো! পাগল মেয়েটার সুখ কপালে সইলো না বলে! সবকিছুই কানে ভেসে আসছিলো, শুধু আমি মেয়েটিকে খারাপ বলতে পারলাম না, না পারলাম ধিক্কার দিতে! আমি জেনেছিলাম ‘মেয়েটি অনেক আগেই মরে গিয়েছিলো যখন তার স্বপ্নগুলোকে মেরে ফেলা হয়েছিলো, সে যে মৃত এতোদিন পর সেই স্বীকৃতিটা পেলো। যে প্রাণহীন দেহ নিয়ে সে এতোদিন ঘুরে বেড়াচ্ছিলো সেটা সৎকার করা প্রয়োজন অনেক দিন পর সেটা চোখে পরলো!’
আপনার মতামত লিখুন :