জোহরা ধাক্কা দিয়ে ড্রেসিং টেবিলটা সরিয়ে দিয়েছে অনেকটা। আমি দ্রুত হাতে সেটা ঠেলে আবার দরজার গায়ে লাগিয়ে দিলাম। তারপর ওয়াশ রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। টিভিটা এখনও চলছে, বন্ধ করার কথা একবারও মাথায় আসেনি। যে কোন সময় জোহরা এসে আবার আক্রমণ করতে পারে এই ভয়ে কাঁটা হয়ে আছি!
কী অসহায় যে লাগছে নিজেকে! গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। একটু আগেও সবকিছু কতো স্বাভাবিক ছিল। আমি আরাম করে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ার আগে কতোই না সুখ-সুখ লেগেছিল!
হঠাৎ ওয়াশ রুমের ভিতরটায় ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলো। বাইরে থেকে লাইট নিভিয়ে দিলো কেউ! জোহরা কি রুমে ঢুকে পড়লো? এখন কী ওয়াশ রুমের দরজার ছিটকিনিও লাথি মেরে ভেঙ্গে ফেলবে?
আতংকে অস্থির হতে গিয়েও শান্ত হয়ে গেলাম। টিভির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না , তারমানে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে। ওয়াশ রুমের লাইট কেউ অফ করেনি। ঠিক তখুনি আমার সেলফোনের রিং টোনটা কানে আসলো। কেউ ফোন করেছে। সেলফোনটা তবে এ ঘরেই আছে, জোহরা লুকায়নি!
ওয়াশ রুমের দরজা সামান্য ফাঁক করে মাথা বের করলাম। নাহ! ড্রেসিং টেবিলটা আগের মতোই দরজা আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, জোহরা ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেনি আর । সাহস করে পায়ে পায়ে বের হয়ে আসলাম। ঘরের চারপাশে তাকালাম। সেলফোনটা এখনও চোখে পড়ছে না। শব্দের উৎস লক্ষ্য করে বিছানার কাছাকাছি এসে বালিশটা উঁচু করতেই ফোনটাকে ভাইব্রেশনের তালে তালে ঘুরতে দেখলাম। মনে হলো এতো মধুর দৃশ্য আর কখনও দেখিনি। এটাকে যে আমিই বালিশের নিচে রেখেছিলাম, সেটা একেবারেই ভুলে বসেছিলাম। এখন ফিরে পেয়ে ফোনটাকে নিজের ত্রাণকর্তা মনে হচ্ছে।
শাশুড়ি মায়ের নাম্বার শো করছে, দ্রুত ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মায়ের উৎকণ্ঠা মেশানো গলা পাওয়া গেলো,
-কী হলো বৌমা! তুমি কি বাসায় নেই? এতোক্ষণ থেকে বেল বাজাচ্ছি, দরজা খুলছো না কেন? জোহরা কৈ? ওকেও সাথে নিয়ে গেছো?
আমি হড়বড় করে বললাম,
-ম! জোহরা পাগল হয়ে গেছে! আমাকে এ্যাটাক করেছিল। আমি ঘর বন্ধ করে বসে আছি।
-কী বলছো পাগলের মতো! জোহরা পাগল হবে কেন? সকালে তো দিব্যি ভালো দেখে গেলাম।
-মা! আমি দরজা খুলতে যেতে ভয় পাচ্ছি। বাসার সামনে তো একটা চাবিওয়ালা বসে। ওকে দিয়ে বাইরে থেকে লক খুলে ভিতরে ঢোকেন মা। আপনি আর ফুপু আম্মা একা ঢুকবেন না। নিচের দোকানের কোন ছেলেকে সাথে করে ঢোকেন। জোহরা আপনাদের ওপরও আক্রমণ করতে পারে।
-এগুলি কী বলে! এ কী আশ্চর্য কাণ্ড!
-প্লিজ মা, আমাকে বিশ্বাস করুন। জোহরার যে চেহারা আমি দেখেছি, তাতে ওকে আমার একদম নিরাপদ মনে হচ্ছে না।
মা ফোন রাখার পর আমি নিলয়কে ফোন করে সব জানালাম। নিলয় মায়ের মতোই বিস্মিত হলো। সে আমাকে সাবধানে থাকতে বললো, মাকে ফোন করে বুঝাবে সেটাও বললো। নিলয়ের অফিসে ছুটির সময় হয়ে এসেছে। ও হয়তো আর আধা ঘন্টার মধ্যে চলে আসবে।
পরবর্তী কিছুক্ষণ উৎকণ্ঠায় কাটার পরএকসময় রুমের বাইরে কিছু সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো। মা মনে হয় লোকজন নিয়ে ঢুকেছেন। আমি ড্রেসিং টেবিল সরিয়ে দরজা খুলে বেড়িয়ে এলাম। মা , ফুপু , চাবিওয়ালা, নিচের দোকানের কর্মচারী সুরুজ সবাইকে দেখতে পেলাম কিন্তু জোহরাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। মা ও ফুপুর চোখে বিরক্তি মেশানো জিজ্ঞাসা। তাদের অনেকটা সময় সিঁড়িতে অপেক্ষা করতে হয়েছে দরজা খোলার জন্য, হয়তো তার বিরক্তি চোখে -মুখে। সুরুজ বললো,
-কী ভাবি! এতো ডরাইছেন ক্যান? কী করছে বুয়া?
আমার খুব মনটা খারাপ হলো। আজ যদি আমার মা এখানে থাকতেন, নিশ্চয় এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে জানতে চাইতেন, আমার কি হয়েছে? কিন্তু মা ও ফুপুর মধ্যে সেই মাতৃসুলভ উৎকন্ঠা প্রকাশ পেলো না। আমি নিজের মাকে মনে করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম।
ফুপু শাশুড়ি বললেন,
-কৈ? জোহরা কৈ?
বলে তিনি জোরে জোরে জোহরাকে ডাকতে শুরু করলেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে জোহরা খুব স্বাভাবিক ভাবে সামনে এসে দাঁড়ালো। শাশুড়ি মা ধমক দিয়ে বললেন,
-গেইট খুলছিলি না কেন?
জোহরা বললো,
-ঘুমায় গেছিলাম।
আমি বললাম,
-তুমি লাথি দিয়ে আমার দরজার ছিটকিনি ভাঙ্গলে কেন?
জোহরা যেন আকাশ থেকে পড়লো! গলায় আর চেহারায় রাজ্যের বিস্ময় ঢেলে উত্তর দিলো,
-এইডা আপনে কী কন ভাবি! আমি লাত্থি দিয়া ভাঙ্গছি? আল্লাগো!
আমি সবাইকে আমার রুমে ডেকে এনে দেখালাম যে ছিটকিনি সত্যিই ভাঙ্গা। তিনতলার কাজের মেয়ে নাহার এসেও সাক্ষী দিয়ে গেলো দুপুরে জোহরার ছাদে পাগলি দেখার ঘটনার। যেটাকে জোহরা ভূত বলেছিল।
এলাকায় এক ভদ্রমহিলা আছেন, আরবি পড়ান। তাকে ছোট-বড় সবাই আরবি খালা বলে। সেই আরবি খালাকে খবর দিয়ে আনালেন ফুপু শাশুড়ি। তিনি এসে জোহরাকে সাথে করে কোন এক হুজুরের কাছে নিয়ে গেলেন। জোহরা যখন ফিরল তখন তার গলায় মাদুলি ঝুলছে।
এরমধ্যে নিলয়ও ফিরে এসেছে। নিলয় বললো,
-তোমার কথাই ঠিক। ছাদে কোন পাগলি উঠেছিল। ওটাকে ভূত-প্রেত ভেবে জোহরা ভয় পেয়ে এমন অসংলগ্ন আচরণ করেছে।দেখবে, এসব ভূত-প্রেত সব সময় গ্রাম থেকে আসা কাজের মেয়েরা দেখে।
আমি বললাম,
-কিন্তু জোহরার চেহারা, গলার স্বর সব বদলে গিয়েছিল!
-বদলাতেই পারে। ওর মাথায় কাজ করছিল যে ও ভূত দেখেছে, ছোটবেলা থেকে ভূতে ধরা , জ্বীনে ধরা মানুষ কেমন আচরণ করে এটা ও শুনেছে লোকমুখে, না হলে চোখে দেখেছে। গ্রামে-গঞ্জে তো এসব কুসংস্কারের কোন অভাব নেই। ওর যখন মনে হয়েছে যে ও ভূত দেখেছে এবং তুমি ওকে বিশ্বাস করছো না, তখন ও ভূতে ধরা মানুষের মতো আচরণ করার চেষ্টা করেছে। তুমি ওর গায়ে পানি ছুঁড়ে মারায় ওর টনক নড়ে আর ঠিক সেই মুহূর্তে ডোরবেল বাজায় ও বুঝে যায় যে মা আর ফুপু চলে এসেছেন। ওদের সামনে নাটক করার সাহস পাইনি তাই পরে ভালোমানুষের মতো এসে বলেছে যে, ঘুমিয়ে ছিল।
-এমন নাটক ও কেন করবে?
-মানুষ অন্যকে চমকে দিতে ভালোবাসে। কিছু মানুষের কাছে এটা নেশার মতো । তারা সারাক্ষণ উদ্ভট কাণ্ড কারখানা করে অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে থাকে। জোহরা এমন ধরনের কেউ হতে পারে। ও কাজে এসেছে কতোদিন হলো?
-এই তো, প্রায় একমাস। ফুপু দেশ বেড়াতে গিয়ে সাথে করে নিয়ে এলেন না?
নিলয় মাথা নেড়ে বললো,
-হু, মনে পড়েছে। এখন কথা হচ্ছে, পাগল-টাগলের এরকম ছাদে উঠে যাওয়া রিস্কি। ছাদ থেকে পড়ে গেলে আরও বড় কেলেংকারি হতো। পুলিশ কেস –টেস হয়ে বিরাট একটা যন্ত্রনা তৈরি হতো।
আমি সুযোগ পেয়ে বললাম,
-একটা দারোয়ান রাখো। তাহলে আর এরকম কেউ হুটহাট উঠে আসতে পারবে না।
-না, দারোয়ান হিসাবে বিশ্বস্ত লোক চাই, এমন মানুষ হুট করে কোথায় পাবো? দারোয়ানদের সাথে অনেক সময় চোর-ডাকাতদের আঁতাত থাকে। বাড়ি খালি থাকলে দারোয়ানরাই চোর –ডাকাতদের খবর দেয় অনেক সময়। আমি বরং দোতলায় উঠার সিঁড়ির মুখে কোলাপসিবল গেইট লাগিয়ে দেই। ওটাতে তালা দেয়া থাকলো। প্রতি তলার কলিং বেলের সুইচ থাকবে গেইটের পাশে। যে তলার বেল বাজানো হবে, তারা এসে তালা খুলে দেবে।
আমি খুশি হয়ে বললাম,
-এটা ভালো আইডিয়া।
পরদিনই মিস্ত্রী লাগিয়ে নিলয় সব ব্যবস্থা করে দিল। আরবি খালা আমাকে কিছু দোয়া লেখা কাগজ দিয়ে গেছেন , সব ঘরে টাঙ্গিয়ে দিতে। আমি তাই দিয়েছি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখলাম শাশুড়ি মা সেগুলি খুলে ফেলছেন। তিনি খুব বিরক্ত হয়ে আমাকে বললেন,
-কেয়া! বাড়িটাকে ভূতের বাড়ি বানিয়ে ফেললে? তোমার ফুপু শাশুড়ি রেনুও তোমার সাথে তাল দিচ্ছে। জোহরার গলায় তাবিজ ঝুলিয়েছে। ঘরে ঘরে দোয়া লেখা কাগজ ঝুলিয়েছো তুমি। তাবিজ-কবজ শিরক, এগুলি করতে হয় না । এই বাড়িতে কোন ভূত নেই, কখনও ছিল না। আর শুনলাম তুমি জোহরাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিতে বলেছো ? গরিব একটা মেয়ে, পেটের দায়ে কাজ করতে এসেছে, ওকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেয়া, মোটেও ভালো কাজ হবে না। কতো ভালো রাঁধে মেয়েটা, সবার যত্নের দিকে তার নজর। ওকে হুট করে ছাড়িয়ে দিলে এতো কাজ করবে কে?
-কিন্তু মা, ও যদি আবার ভায়োলেন্ট হয়ে যায়?
-কোথায়! আমি তো ওকে শান্তই দেখি। পুরানো বাড়ি। দরজার ছিটকিনিটাও পুরানো হয়ে গেছিলো। জোরে ধাক্কা দেয়ায় খুলে পড়ে গেছে! এটাকে এতো সাংঘাতিক করে ভাবার কিছু নেই। ও আমার শ্বশুরের দেশের মেয়ে। চোর-চোট্টা নয়। তুমি মা, ভয় আর সন্দেহ একটু বেশি করো।
-কিন্তু মা, ও আমার দরজায় এতো জোড়ে ধাক্কা দেবেই বা কেন?
মা বললেন,
-ও আমাকে বলেছে কেন ধাক্কা দিয়েছে। আমি ডাকছি ওকে। ওর মুখেই শোন। জোহরা...!
সুর করে , লম্বা টানে জোহরাকে ডাকেন শাশুড়ি মা।
জোহরা কিচেন থেকে হন্তদন্ত হয়ে আসে। হাতে খুন্তি।
শাশুড়ি মা বললেন,
-আলুর পরোটা হয়ে গেছে?
-জ্বি মামী।
-কেয়ার দরজায় ওমন করে ধাক্কা দিয়েছিলি কেন তুই? ভাবিকে বল। ও তো খুব ভয় পাচ্ছে।
-ভাবি ইমুন ভয় পাইবো, আমি তো বুঝি নাই। ভাবিরে যহন ডাকছি বারান্দা থন পাগলিরে দেখার লাইজ্ঞা, তহন পাগলি লুকাইছে। ভাবি যেই দৌড়াইয়া ঘরের ভিত্রে হান্দছে, তহনই পাগলি আবার আইছে। আমি তাই আবার ভাবিরে দরজা ধাক্কাইয়া ডাকছি। ছিটকিনি ভাইঙ্গা পড়বো, আমি কি জানতাম। ভাবি দরজার সামনে ড্রেসিং টেবিল টাইনা রাখছে দেইখা হাসতেছি, ওমা! ভাবি শইলে পানি ছুইড়া মারলো! তহন বুঝছি ভাবি ডরাইছে। হ্যাসে আমি গেছি গা, আর ডাক পাড়ি নাই।
আমি বললাম,
-তাহলে ডোরবেল বাজার পর দরজা খোলো নাই কেন?
-আমি ভেজা কাপড় বদলাইতে গেছিলাম বাথরুমে, বেল শুনি নাই। পরে ঘুম দিছি।
আমি জোহরার কথায় যুক্তি খুঁজে পেলাম। ঠিকই আছে। কিচেনের পাশের বাথরুমটা অনেক দূরে। ওখান থেকে বেল শুনতে পাওয়ার কথাও নয়। আর তারপর ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছিলো। তাই মা বাইরে থেকে বেল বাজিয়েছেন কিন্তু আর শব্দ হয়নি। ফোন করায় আমি জানতে পারি মা বেল বাজিয়েছিলেন।
কিন্তু যুক্তি মিললেও আমার মনের খচখচানি যাচ্ছে না। শুধু মনে হচ্ছে কোথাও কিছু একটা অস্বাভাবিকতা আছে। যেটা নানান যুক্তির তোড়ে আড়ালে চলে যাচ্ছে, আমরা কেউ ধরতে পারছি না।
সেদিন রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ফুপু আমাকে তার রুমে ডাকলেন। আমি যেতেই তিনি বললেন,
-দরজা বন্ধ করে পাশে এসে বসো।
আমি পাশে এসে বসলাম। তিনি হাসতে হাসতে বললেন,
-কাল ভয় পেয়েছিলে খুব, তাইনা?
আমি লজ্জা পেয়ে মাথা নামালাম। সত্যিই হয়তো বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি কাল ।
ফুপু কাছে এসে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন,
-তোমার ধারনাই ঠিক। জোহরা সেদিন স্বাভাবিক ছিল না। ওর ওপর ভর করেছিল।
আমি চমকে উঠে বললাম,
-কে ভর করেছিল?
-এই বাড়ির আশেপাশে যে থাকে, সে। যাকে ছাদের ওপর গোসল করতে দেখেছে ও । ওটা পাগলি ছিল না। ওটা অন্যকিছু। বহুবছর ধরে এই এলাকায় থাকে। হঠাৎ হঠাৎ দেখা দেয়। ভালো জিনিস না। খারাপ জিনিস। জোহরাকে নিয়ে তাই ভয় লাগছে। এইজন্যই শোনার সাথে সাথে আরবি খালাকে খবর দিয়ে আনিয়ে তাবিজের ব্যবস্থা করেছি। তোমার শাশুড়ি সব জেনেও না জানার ভান করছে, তুমি ভয় পাবা বলে।
-জোহরাকে তবে দেশে পাঠিয়ে দেন।
-না মা, গরিবের মেয়ে , বিয়ে হলো, স্বামী কয়দিন পর তাড়িয়ে দিলো। এখানে এসেছে পেটের টানে। এখন এসে পড়লো খারাপ জ্বীনের খপ্পড়ে। ওকে জ্বীন না ছাড়িয়ে দেশে পাঠিয়ে দিলে বেচারি পাগল হয়ে পথে ঘাটে ঘুরে বেড়াবে। আমি ওকে সুস্থ করে তবে ফেরত পাঠাবো। তুমি ওর কাছ থেকে একটু দূরে দূরে থাকবে আর এই তাবিজটা সাথে রাখো। কখনও কাছ ছাড়া করবা না । তাহলে আর তোমার কোন ক্ষতি ও করবে না। আরেকটা কথা, আমি যে তোমাকে এসব বলেছি, সেটা নিলয় বা তোমার শাশুড়ি, কাউকে বলো না। ওরা আমার ওপর মনক্ষুণ হবে তোমাকে ভয় দেখিয়েছি বলে। আমি তো মা তোমায় ভয় দেখাচ্ছি না, সাবধান করছি। এটা ওরা বুঝতে চাইবে না। আর শোন মা , তোমার ঘরের উত্তর দিকের জানালা তুমি খুলেছো কেন? তুমি কি খেয়াল করেছো, ওপরের তিনতলা আর চারতলায় উত্তর দিকে কোন জানালা নেই? কেন নেই জানো? তুমি যেদিন উত্তর দিকের জানালাটা খুললে, সেদিনই আমি ভেবেছিলাম একটা অঘটন ঘটবে। মাগরিবের আগে তোমার শাশুড়ি হন্তদন্ত হয়ে উত্তর দিকের বারান্দার দরজা কেন বন্ধ করে জানো? এমনি এমনি না। কারণ আছে।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,
-কী কারণ ?
ফুপু শাশুড়ি কিছুক্ষ চুপ করে থেকে বললেন,
-না থাক, ওটা বলবো না। ওটা শুনলে তুমি ভয় পাবে। তুমি তোমার রুমের উত্তর দিকের জানালা আজই বন্ধ করবে। তুমি সাথে তাবিজটা রাখো তাহলে সে তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তুমি নামাজ-কালাম পড়া মেয়ে, তোমার কাছে ওরা আসবেও না। যাও মা ভয় পেও না। চার কুল পড়ে শুয়ে পড়। কোন ভয় নেই।
ফুপু শাশুড়ি যতোই বলুন, ভয় নেই, তিনি এতোক্ষণ ধরে যা শোনালেন তাতে জোহরাকে নিয়ে আমার ভয়টা আবার ঝাঁকিয়ে বসলো। নিজের রুমে ফিরে তাবিজটা হাতে বেঁধে নিলাম তারপর উত্তর দিকের জানালা বন্ধ করে দিলাম। বিয়ের পর এই রুমে এসে দেখেছিলাম জানালাটা সব সময় বন্ধ থাকে। খোলার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখি বহুদিন না খোলায় জানালার পাল্লা দুইটা লোহায় জং ধরে শক্ত হয়ে আটকে রয়েছে। নিলয় অনেক কসরত করে জানালাটা খুলেছিল। আমি বলেছিলাম,
-এই জানালাটা তোমরা কেউ খুলতে না কেন?
-এটা আসলে মায়ের রুম ছিল। আমার বিয়ে উপলক্ষ্যে মা আমার রুমটা নিয়েছেন আর মায়ের রুমটা আমাদের ছেড়ে দিয়েছেন। মা কেন এই জানালা খুলতেন না, আমি জানিনা।
আজ আবার সেসব কথা মনে পড়ছে। তবু আমি নিলয়কে বললাম,
-এই জানালাটা কেন বন্ধ থাকতো নিলয়?
নিলয় মনোযোগ দিয়ে তার ল্যাপটপে কিছু করছিল। চোখ না তুলে বললো,
-কোন জানালা?
-উত্তরের।
নিলয় এবার চোখ তুলে জানালাটা দেখে আবার কাজে মনোযোগ দিতে দিতে বললো,
-তোমাকে তো বলেছি, মা খুলতেন না।
-কেন?
-জানিনা, মা জানেন। এতো রাতে আবার জিজ্ঞেস করতে ছুটো না। মা শুয়ে পড়েছেন। কাল জিজ্ঞেস করো।
আমি সত্যিই মাকে প্রশ্ন করবো বলে মায়ের ঘরে যেতে চেয়েছিলাম। নিলয়ের কথায় নিরস্ত হয়ে শুয়ে পড়লাম একটা গল্পের বই নিয়ে। নিলয় যতোক্ষণ কাজ করবে, ঘরে আলো জ্বলবে। এখন ঘুমানোর চেষ্টা করে লাভ নাই, বরং বই পড়ি।
বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একটু শীত শীত লাগায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সারাদিন ধরে বৃষ্টি হওয়ায় আজ আবহাওয়াটা বড্ড ঠান্ডা। ফ্যানের হাওয়ায় শীত করছে। ফ্যান কমিয়ে দিলে নিলয়ের আবার গরম লাগবে, ওর গরম বেশি। আমি তাই পায়ের কাছ থেকে চাদরটা টেনে নিলাম গায়ে । কিন্তু নিলয়ের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। ঘরের মধ্যে দুইটা নিলয়!
বেড সাইড ল্যাম্পের আলোয় আমি স্পষ্ট দেখলাম, একজন নিলয় বিছানায় শুয়ে আছে। আরেকজন নিলয় শুয়ে থাকা নিলয়ের পাশে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখছে! প্রচণ্ড ভয় পাওয়ার পরও আমি বোঝার চেষ্টা করলাম কোনটা আসল নিলয়? যে শুয়ে আছে সে, না যে বসে আছে সে? আমি এখন কোনন নিলয়কে ডেকে বলবো যে আমার ভয় লাগছে, প্রচণ্ড ভয় লাগছে!
হঠাৎ বসে থাকা নিলয়ের শরীর কাঁপতে শুরু করলো। কাঁপতে কাঁপতে তার কোমরের ওপরের অংশ অদৃশ্য হয়ে গেলো। এখন বিছানার ওপর শুধু তার কোমরের নিচের অংশটা রয়েছে।
এই ঘটনায় আমি নিশ্চিত হলাম বিছানায় শুয়ে থাকা নিলয় আসল নিলয়। আমি ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম আসল নিলয়কে,
-নিলয়! নিলয়!
বার কয়েক ডাকলাম। কিন্তু আমার গলা দিয়ে ভয়ে স্বর বেড়োচ্ছে না। শরীরও অবশ লাগছে ! গায়ে যেন কোন শক্তি নেই। আমার ধাক্কায় নিলয়ের ঘুম ভাঙ্গছে না। উত্তর দিক থেকে ঝড়ো বাতাস এসে গায়ে লাগলো। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম-উত্তর দিকের জানালা খোলা!
অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি শোয়ার আগে ওটা বন্ধ করেছিলাম!
আপনার মতামত লিখুন :