‘এই তুই হাসতাছিস কেন! এই হারামজাদি হাসতাছিস কেন’ বলতে বলতে রনক চুলের মুঠি ধরে তলপেটে আরো দুইটা লাথি দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল!
মানুষের কিছু কিছু আচরণের স্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকে না তার নিজের কাছে! তবে আড়ালে থাকে অস্পষ্ট কিছু কারন! বিয়ের ২৮ দিনের মাথায় রনক প্রথম আমার গায়ে হাত তুললো তার শার্ট ঠিকমত আয়রন করা হয়নি বলে! তার এমন আচরণ যতটা কষ্ট দিল তার চেয়েও বেশী আমাকে অবাক করলো! সময় যেতে লাগল আমার গায়ে হাত তোলার নিয়ম তার জন্য সহজ হয়ে গেল! মায়ের কাছে কান্নাকাটি করে বলেছিলাম, ‘এমন মানুষের সাথে সারাটা জীবন কিভাবে কাটাই, বলতো মা!’ আমার কথায় মাও খুব কাঁদলো আর বলল, ‘মাগো মেয়ে মানুষ শুধু সম্পর্কে জড়ায় না সাথে মায়ায়ও জড়ায়!মেয়ে মানুষের শরীরে মায়া বেশী এজন্যইতো আমরা মায়ের জাত।পুরুষ মানুষের মন শক্ত এদের মায়া বাড়ে আস্তে আস্তে! তুই একটু ধৈর্য ধর মা, দেখিস সব ঠিক হইয়া যাইবো!’
মা বলেছিল ধৈর্য ধরতে তবে, কতটা ধৈর্য ধরলে সব ঠিক হয়ে যাবে সেটা বলেনি! যেদিন রনক আমাকে মেরে হাত ভেঙে দিল সেদিন ভাইয়া আর মা এসে আমাকে নিয়ে গেল। কেন যেন মনে হয়েছিল, এই বুঝি নরক থেকে মুক্তি পেলাম। এরকম না যে মানুষটার জন্য আমার মনে কোন মায়া জন্মায়নি তবে যতটা মায়া জন্মেছে তার চেয়েও দিগুণ হারে তার প্রতি ভয় জন্মেছে!
মেয়েমানুষ দুঃখ কষ্টে অশ্রু বিসর্জন দিবে আর ছেলেমানুষ যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতেও থাকবে দৃঢ়, এটা দুনিয়ার সবচেয়ে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একটা নিয়ম! আর এই নিয়মের বরখেলাপ করে যদি কোনো পুরুষ মানুষ দুইচার ফোটা অশ্রু গড়াতে দেয় সেই দৃশ্য হয়ে ওঠে খুবুই আবেগপূর্ণ আর নিঃসন্দেহে বিশ্বাসযোগ্য! আমি ফিরে আসার ৭ দিনের মাথায় রনক মার কাছে ভাইয়ার কাছে ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করলো, তার মাথা ঠিক ছিলনা, এবারের জন্য যেন তাকে মাফ করে দেওয়া হয়, আর কখনও সে এমন করবে না!
মা এসে আমাকে জানিয়ে দিল কাল রনক আমাকে নিতে আসবে! আমি যখন ফ্যালফ্যাল চোখে মার দিকে তাকিয়ে, তখন মা বলল, ‘মাগো সংসার কি এতো সহজ জিনিস চাইলেই ভাঙা যায়? তোমার আরও ছোট দুইটা বইন আছে তাদের বিয়ে দিতে হইবো, তুমি যদি সংসার করতে না পাইরা ফিরা আসো, তাইলে তাদের বিয়ে দেওয়া যাইবো না! মানুষ নানা রকম কথা বলব। বলব, এই বাড়ির মেয়েদের চরিত্র ঠিক নাই! তোমার বাবা নাই তোমারে যে কত কষ্ট কইরা বিয়ে দিসি তাতো তুমি জানোই! তোমার ভাইয়ের টাকায় সংসার চলে, ওর বিয়ের বয়স হইসে, আজ হোক কাল হোক শুভ বিয়ে করলে নিজের সংসার নিয়া ব্যস্ত হইয়া যাইবো, তখন আমি তোমাগো তিন বইনেরে লইয়া কই যাইবো, বল তো!’
সেদিন দুই দিকের দুই জোড়া চোখের অসহায়ত্ব আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল সম্পর্কের প্রতি মায়া লাগা আর সম্পর্কের দায়িত্ব নেওয়ার মাঝে রয়েছে আকাশ পাতাল ব্যাবধান!
আমার প্রায়ই শ্বাসকষ্ট হয়। রনক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার অনেক পরিক্ষা নিরিক্ষা করে জানাল, ‘আপনার শরীরে কোনো রোগ নেই, হয়ত সমস্যাটা মানসিক!’ সেদিন আমার ডাক্তারকে বলতে ইচ্ছে করেছিল, আমি জানি ডাক্তার আমার রোগের নাম কি! আমার রোগের নাম ভয়! আসলে যেদিন কাজকর্মে কিছুটা দেরী অথবা কোনো ভুল হয়ে যেত, রনক অফিস থেকে আসার সময় হলেই আমার হাত পা কাপতো, বুক ধরফর করতো, ভয়ে এমন লাগতো যেন নিঃশ্বাস এই বুঝি বন্ধ হয়ে গেল!
ছেলেটা হওয়ার পরে ভুল করেও আর কোনোদিন সংসার ছাড়ার কথা ভাবিনি! মনে হতো হোক সে স্বামী হিসেবে খারাপ, বাবা হিসেবে তো খারাপ নয়! শুধুমাত্র আমার কষ্টের জন্য ছেলেটাকে বাবার আদর থেকে বঞ্চিত করবো? আর আমার ছেলের ভবিষ্যত সেটা কি হবে? আমি একা কি ওকে একটা ভাল জীবন দিতে পারবো? তার চেয়ে বরং চলুক জীবন যেভাবে চলছে, একটা জীবনইতো কোনো না কোনভাবে কেটে যাবেই!
আমার শাশুড়ি বেড়াতে আসলে একবার কথায় কথায় বলেছিলাম ‘আম্মা ইলাফের বাবা কথায় কথায় আমার উপর হাত তোলে।’ কথাটা আসলে বিচার দেওয়ার জন্য বলিনি! মনে হয়েছিল হোক সে রনকের মা কিন্তু তিনি তো একজন মেয়েমানুষ, একজন মেয়েমানুষ কি আরেকজন মেয়ে মানুষের দুঃখ বুঝবে না? নাহ বুঝেনি, রেগে গিয়ে বলেছিল, ‘আমার রনক কোনোদিন একটা বিড়ি, সিগারেটও খায় না, কোনোদিন কোনো মেয়ের দিকে খারাপ চোখে তাকায় না! এমনও না তোমাকে ইলাফকে ভাত কাপড়ের কষ্ট দিচ্ছে, তারপরেও তুমি বলতে চাও আমার ছেলে খারাপ! ছেলে মানুষ কত কষ্ট কইরা টাকা কামাইতে হয় সেটা তো তুমি ঘরে বইসা টের পাওনা! নিজের স্বামীর মেজাজ সহ্য করতে পার না, কেমন মেয়ে মানুষ তুমি!’
আম্মার কথায় সেদিন বুঝেছিলাম মেয়ে মানুষের জীবনের সুখের হিসেব হয় ভাত কাপড়ে! ভাত কাপড় ঠিকঠাক মত পেলে আর কিছু নিয়ে অভিযোগ করা উচিৎ না! আর ছেলে মানুষের চরিত্রের সার্টিফিকেট যেইসব বিষয়ের উপর ভিত্তি করে দেওয়া হয় সেখানে রনক খুব সম্মানের সাথেই পাস করে গেছে!
আমার ছেলেটা ৬ বছরের ছোট্ট ইলাফ, কাল ওর স্কুল থেকে আমাকে ডাকা হয়েছিল! প্রিন্সিপাল ম্যাডাম জানতে চাইলো, ‘ইলাফের কি কোনো সমস্যা আছে?’ আরও স্পষ্ট করে বলল, ‘আই মিন, আমি জানতে চাচ্ছিলাম, এমন কি কোনো বিষয় আছে যেটা আপনার ছেলেকে মেন্টালি ডিস্টার্ব করছে?’ আসলে ইলাফ কারো সাথে মিশে না, কারো সাথে কথা বলেনা, বিষয়টা শুরুতে তারা স্বাভাবিকভাবে নিলেও ইদানিং তাদের মনে হচ্ছে এই ছেলেটার কোনো সমস্যা আছে! আমি বললাম, ‘আসলে আমার ছেলেটা এমনিতেই চুপচাপ কোনো সমস্যা নেই।’ কোনো রকম আমি সাত পাঁচ বলে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম!
ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মনে মনে বললাম, ‘কেন বড় হয়ে যাচ্ছিস বাবা! কেন এতো কিছু বুঝতে পারিস! কেন এতো কিছু নিয়ে ভাবিস তুই!’ আমার গায়ে যখন ওর বাবা হাত তুলে ছেলেটা রুমে থাকলে দৌঁড়ে অন্য রুমে চলে যায়! কখনওবা পর্দার আড়ালে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে! আবার কখনও ছোট্ট হাত দুইটা কানে গুজে রাখে যেন আমার চিৎকার তার কান পর্যন্ত না যায়! আর বেশীরভাগ সময়ই সামনে দাঁড়িয়ে থেকেই চুপচাপ দেখে যায়, হয়ত সম্পর্কের রহস্য বোঝার চেষ্টা করে! অথচ আমার ছেলেটা ৩ বছর সাড়ে তিন বছর পর্যন্ত স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতই হাসতো খেলতো! বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে আমার ছোট্ট ছেলেটার সেই খিলখিল হাসিটা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে! মাঝে মাঝে মনে হয় সেই ছোট্টবেলাটির মত অবুঝ-ই থেকে যাক আমার ছেলেটা! বড় হলেই যে জীবন জানতে হবে, সম্পর্কে দুর্বোধ্য বেড়াজালে আটকে যেতে হবে! কি অদ্ভুত তাই না? জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সম্পর্কগুলো আমাদের জিবনের গতিপথ নির্ধারন করে দেয়, আমরা সুখের পথে হাঁটব না দুঃখকে আষ্ঠেপিষ্ঠে জড়িয়ে জীবনকে শুধু টেনে নিয়ে যাব! সুখ আর দুঃখ ভাগাভাগিতে দুটোই বাড়ে! তাই আজকাল চুপচাপই সবকিছু সহ্য করি, কাউকে কিচ্ছু বলতে ইচ্ছা করে না!
আচ্ছা আজ সকালে রনক যখন আমার গায়ে হাত তুলল, কেন আমি হেসে দিয়েছিলাম? কি হতে পারে কারন? সংসার জীবনের এই ৮ বছরে রনকের এতো মার খেয়েছি যে আমার শরীরটা অসাড় হয়ে গেছে, ও যতটা শক্তি দিয়ে আমাকে মারে ঠিক ততটা কষ্ট আমি পাইনা! শুধু কি এটাই কারন? আমার যেই ছেলেটার ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি এই নরকে পড়েছিলাম, কাল আমি জেনে গিয়েছিলাম, আমার ছেলেটা ভাল নেই! আমার ছেলেটা কষ্টে আছে, মানসিক কষ্ট! যেটা সম্পর্কের নিষ্ঠুরতা তাকে প্রতিনিয়ত দিচ্ছে! আর? আমি নিজেকে মুক্ত করে দিয়েছি এই অনিচ্ছাকৃত, টেনে নেওয়া নরক যন্ত্রণা থেকে! হয়ত খুজলে আরও কিছু কারন পেয়ে যাব! জীবনের সব রহস্য বেধ করতে হয় না, সব রহস্য বেধ করে ফেললে বেঁচে থাকার আগ্রহ কমে যায়! কিন্তু আমাকে যে বাঁচতে হবে নিজের জন্যে আমার ইলাফের জন্যে!
কি অদ্ভুত! আমার ভিতু ছেলেটা, যে সবসময় ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকে সেই ছেলেটার চোখেমুখে সেই আতংক আর নেই! তার ছোট্ট হাত দিয়ে আমার হাতটা সে শক্ত করে ধরে রেখেছে! শহরের এই পিচ ডালা পথে আমরা মা ছেলে হাটছি! আমরা জানিনা আমাদেত গন্তব্য কোথায়! জীবন আমাদের কোথায় নিয়ে দাড় করাবে! তবে আমরা হাটছি! একটু একটু করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি মুক্তির আশায়!
আপনার মতামত লিখুন :