ভোর পাঁচটা। ঘুম থেকে উঠে নিত্য দিনের মতো আজও ঘর থেকে বের হল যুথী। তারপর হাঁটতে লাগল বাঁধের রাস্তা ধরে। আজ বেশ কিছুদিন হলো অভ্যেসটা হয়েছে তার ভোরের সূর্য ওঠা দেখার। হাঁটতে হাঁটতে পৌছে গেলো গ্রোয়িং বাঁধের উপর। এখান থেকে খুব ভালো করে সূর্য ওঠা দেখা যায়। এখনো সূর্য উঠতে কিছুটা দেরী আছে। তার পরও অপূর্ব লাগছে নদীর পাড়। দূরের চর থেকে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
বাঁধের সাথে পানির ধাক্কা লেগে কলকল শব্দ হচ্ছে। পূবের মিষ্টি হাওয়া এসে যুথীর শাড়ির আঁচল উড়িয়ে দিচ্ছে অনবরত। আশে পাশে তেমন কেউই নেই। শুধু দূরে কয়েকটা মাছ ধরা নৌকা দেখা যাচ্ছে। আর নৌকাগুলো সম্ভবত এদিকেই আসছে। কারণ আজ হাটবার। তাই মাঝিরা মাছ নিয়ে হাটে আসছে। সারারাত ওরা মাছ ধরে। আর সকালে তা হাটে বিক্রি করে। তারপর খেয়েদেয়ে সারাদিন ঘুমায়। এ ভাবেই চলে ওদের জীবন।
যুথীর বড় অদ্ভুত লাগে জেলেদের জীবন। মনে হয় কি নিশ্চিত জীবন ওদের। কোন উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, নেই কোন বিলাসী ভাবনা। শুধুমাত্র বেঁচে থাকবার জন্য যা দরকার তাই ওদের প্রোয়োজন। অথচ আমাদের কত চাহিদা। থাকবার মত বাড়ি হলে আমাদের প্রোয়োজন হয় গাড়ির। মনে হয় গাড়ি ছাড়া আর সমাজে মুখ বাঁচেনা। বাচ্চারা বায়না ধরে, ‘আব্বু আম্মু, আমার অমুক বন্ধুর কম্পিউটার আছে আমাদের নেই কেন। আমার অমুক বন্ধুর আলাদা পড়ার ঘর আছে, তাদের উন্নত মানের পড়ার টেবিল, আমার নেই কেন’ ইত্যাদি প্রশ্নে জর্জরিত করে আমাদের সন্তানেরা। অথচ এই মাঝিদের কি নিশ্চিত জীবন। মাছ ধরে যা পায় তাই দিয়েই তাঁদের সংসার চলে।
মাঝিরা খুব কাছে এসে গিয়েছে যুথীর। ওরা নৌকা ঘাটে বেঁধে রেখে মাছ নিয়ে হাটের দিকে চলতে লাগল। মাছ নিয়ে গেলো দুজন আর নৌকায় রয়ে গেলো একজন। যুথী জিজ্ঞেস করল, ‘কি মাছ পেয়েছেন আজ, দেখিত’ বলেই মাথা নামিয়ে দেখতে লাগল। যুথী দেখল রুপোর মত সাদা চকচকে মাছ। বৈরালি, উপর চোখা, দুটো মাঝারী সাইজ এর বোয়াল মাছও পড়েছে। অন্য পাতিলের ঢাকনাটা সরানো মাত্রই যুথী দেখল বড় বড় চিংড়ী মাছ। মাছগুলো এখনো লাফাচ্ছে। মাছগুলো দেখে যুথীর অনেক আনন্দ হল। ওর মনে হল সব মাছগুলো কিনে নেয়। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হল এতো টাকাতো তার কাছে নেই। মাছওয়ালা বলল, ‘আপা মাছ নেবেন?’ যুথী বলল, ‘অন্য আর একদিন নেবো, আজ না।’
মাছওয়ালা চলে গেলো। হঠাৎ যুথীর বুকের ভেতরটায় মোচড় দিয়ে উঠল। চোখ দুটি নিমিষেই ঝাঁপসা হয়ে গেলো। পানি পড়তে লাগল টপটপ করে। যুথীর আজ খুউব মেয়ের কথা মনে হল। ওর চিংড়িমাছ ভীষণ প্রিয়। যুথীর মেয়ের নাম চৈতি। ও অনেক সময় দুষ্টুমি করে বলতো আমার জাতীয় মাছ চিংড়ী। মাছওয়ালা তাঁদের গন্তব্যে চলে যায়। যুথী দেখে ধীরেধীরে পূর্ব আকাশে লাল টকটকে সূর্য উঠছে।
এই সময়টা ভীষণ ভাল লাগে যুথীর। আবারো আর একটি দিন শুরু হল। পূর্ব পাশ থেকে ঘুরে দাঁড়ায় সে। পশ্চিম পাশে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করে। বাম হাতটি তুলে সময় দেখতে গিয়ে মনে পড়ে ঘড়ি পরেনি হাতে। ভাবে কটা আর বাজে, সাড়ে পাঁচটা হবে হয়ত।
হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরে যুথী। বাড়ি পৌছে দেখে এখনো কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। তবে আনারুল চাচার ছোট ছেলেটা মনে হয় জেগেছে। চাচীকে যে বিরক্ত করছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে তাঁর চাপা কান্না শুনে। ঘরে যাবার আগেই কলপাড়ে গিয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ভাল করে হাত পা ধুয়ে তালা খুলে ঘরে এসে খাটের এক কোণে বসে যুথী। ঘরের চারদিকে চোখ বুলায় সে। এই ঘরেই যে তার বর্তমান সংসার। বাঁশের বেড়া দেয়া উপরে টিনের চালাটি বাইরে থেকে অতোটা সুন্দর নয় কিন্তু ভেতরটা আবার ততোটা অসুন্দরও নয়। ঘরটির এক কোণায় একটি সেমি ডাবল কাঠের তৈরী খাট। সেই খাটে শিমুল তুলা দিয়ে বানানো তোষক, মাথার দুটি বালিশ ও একটি কোলবালিশ।
তোষকের উপর পাতানো চেক প্রিন্টের চাদর। তাঁতীদের বানানো। নদীর ওপারের তাঁতীরা নিজ হাতে বানায় এই চাদর। যুথীর অনেক পছন্দ এই তাঁতের চাদর। খাটের সাথে লাগানো পড়ার টেবিল। টেবিলের সাথেই সেট করা সেল্ফে বেশ কিছু বই। সব তার প্রিয় লেখকদের প্রিয় বই। একটি কাঠের চেয়ার, একটি ছোট আলনা আর একটি কাঠের বাক্স। কদিন আগেই হাট থেকে বাক্সটি কিনে আনিয়েছে সে তার ছোট চাচাকে দিয়ে। আম কাঠের তৈরী। মনে হয় একটি জোরে ঘুঁষি মারলেই ভেঙে যাবে। কিন্তু কি আর করা! প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র কিছু খাবার জিনিষ, যেমন বিস্কুটের ডিব্বা, চা পাতা, চিনি, এগুলো রাখতে হবেতো! আর তাই তাকে অগত্যা এটি কিনতেই হল।
বাক্সটির উপর এমনভাবে একটি ঝুল লাগানো পর্দা বিছিয়েছে সে, খুব ভাল করে না দেখলে বোঝার উপায়ই নাই যে এটি একটি কম দামের আম কাঠের বাক্স। একেবারে টেবিলের মতো লাগে দেখতে। আর তার উপর একটি ফুলদানী। সব সময় কিছুনা কিছু তাজা ফুল থাকেই সেখানে। যদিওবা এই নদী পাড়ের গ্রামটিতে চেনা ফুলের সমাহার খুবই কম। ঘরের আর এক কোণে একটি টুলের উপর স্টোভ, কেরোসিন এর। ঘড়িতে সময় দেখে যুথী সকাল সাড়ে ছটা। এই সময়টায় ভীষণ চায়ের তেষ্টা পায় তার। বিছানা থেকে উঠে এসে স্টোভ জ্বালিয়ে কেটলিতে চা এর পানি বসিয়ে দেয় সে।
কেটলিতে পানি দিতে গিয়ে মনে পড়ে দাদীর কথা। দাদী হয়তবা উঠে গিয়েছে এতোক্ষণে। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে যুথী। হ্যাঁ, দাদীর ঘরের দরজা খোলা। মোট তিন কাপ পানি কেটলিতে বসিয়ে দিয়ে দাদীকে ডাকতে যায় সে।
দাদী সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছে কয়লা দিয়ে। যুথী দাদীকে তাড়াতাড়ি মুখ ধুতে বলে। বলে, ‘দাদী চা বানাচ্ছি, আসেন একসাথে চা খাই।’ চায়ের কথায় দাদীর চোখ দুটি খুশিতে জ্বলে ওঠে। চা তার অনেক পছন্দ। কেউ ভাত না দিয়ে যদি সারাদিন চা খেতে দিতো, তাতেই মনে হয় তিনি বেশি খুশি হতেন। চায়ের পানি শুকিয়ে গিয়ে দু কাপ হয়েছে। দ্রুত টেবিল থেকে তার মগটি নিয়ে আসে সে। চেঁচিয়ে দাদীকে বলে, সাথে করে তার মগটি নিয়ে আসতে। বলার সাথে সাথেই দাদী মগ হাতে হাজির হয় যুথীর ঘরে। দাদীর মগে দুই চামুচ আর নিজের মগে এক চামুচ চিনি দিয়ে চা ঢেলে দেয় কেটলি থেকে। দুধ ছাড়া রঙ চা। বিস্কুটের ডিব্বা খুলে চারটা টোষ্ট বিস্কুট নিয়ে দুটো দুটো করে ভাগ করে গল্প করতে করতে চা খায় তারা।
যুথীর খাবার আনারুল চাচা অর্থাত মেঝো চাচার সাথেই হয়। সব সময় চাচীকে তার বিরক্ত করতে ইচ্ছে হয়না। আর তাই এই চায়ের আয়োজনটি সে তার নিজের ঘরেই রেখেছে। এতে করে অবশ্য দাদী মহাখুশি। কারণ দুবেলা তার চা এর চিন্তা নেই।
দেখতে দেখতেই বেলা বেড়ে ওঠে। এক এক করে সবার ঘুম ভাঙে। সকাল আটটা। গোসল সেরে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে স্কুলে চলে যায় যুথী। তার স্কুলটি নদীর ওই পাড়ের চরে। স্কুলের নাম মমিনপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। আজ সাত মাস হল এই স্কুলে তার প্রথম চাকরি সহকারী শিক্ষক হিসেবে।
এখন চৈত্র মাস। নদীতে চর জেগেছে। হাঁটতেই হয় বেশি। বাড়ি হতে প্রায় মাইল খানেক হেঁটে মাত্র দশ মিনিট নৌকায় তারপর আবার আধা মাইল হেঁটে তবেই স্কুল। শাড়ি পরে কাঁধে লম্বা ব্যাগ ঝুলিয়ে পায়ে বাটার ফ্লাট স্যান্ডেল পরে ছাতা মাথায় যখন যুথী স্কুলে যায়, তখন ওকে ভারী সুন্দর দেখায়। আশেপাশের লোকজন সবাই তাকিয়ে থাকে তার দিকে কৌতুহল নিয়ে। প্রথম প্রথম তো সবাই দল বেঁধে দেখতে আসতো। ওরা ভীষণ অবাক হয়ে দেখত যুথীকে! ওদের মাঝে যারা তাকে চিনতো, তাঁরা বলতো, ‘এইতো সেদিনের মেয়ে যুথী। এই নদী পারেই ওর জন্ম। আর আজ কত বড় হয়েছে স্কুলে মাষ্টারি করে!’
এখন আর অত কৌতুহল নিয়ে তারা যুথীকে দেখেনা। যে যার কাজেই ব্যস্ত থাকে। তবে, কারো সামনে পড়লে দুটি কথা বলবেই। ঘড়ি দেখে জোরে জোরে পা চালিয়ে হাঁটতে থাকে সে। বারবার বালুতে পা পিছিয়ে যেতে থাকে তার। নদীতে চর জেগেই এই কষ্ট। প্রথম প্রথম তো পায়ে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল। মেঝো চাচা বলেছে, ‘এই দুই মাস একটু কষ্ট করতেই হবে। বর্ষাকালে আর হাঁটতে হবে না। তখন বাড়ির সামনেই ঘাটে নৌকায় উঠে একেবারে ওই পাড়ে স্কুলের সামনেই নামা যাবে।’
স্কুলে পৌঁছেই কল থেকে পানি চেপে মুখে কিছুক্ষণ পানি দিয়ে মুখ না মুছেই বসে থাকে যুথী। তাকে দেখে পারভিন হেঁসে বলে, ‘কি ব্যাপার আপা, আজ খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে আপনাকে।’ রুমাল দিয়ে আস্তে করে মুখটি মুছে ফেলে যুথী। হেঁসে বলে, ‘কই না তো! আজ অনেক রোদের তেজ, তাইনা পারভিন?’
যুথীকে পারভিন ভীষণ পছন্দ করে। অবিবাহিতা মেয়ে পারভিন পড়ালেখা পুরোপুরিভাবে শেষ না হতেই চাকরি পেয়েছে এই স্কুলে। যুথীরও তাঁকে অনেক পছন্দ। যুথী যখন প্রথম এই স্কুলে যোগদান করে, তখন একই সাথে পারভিন ও যোগ দেয়। নদীর এই পাড়েই কাঁকিনা হাটে পারভিনদের নিজস্ব বাড়ি। প্রথম প্রথম এত কষ্ট করে যুথীর স্কুলে আসা দেখে পারভিন অনেক অনুরোধ করেছিল তাঁদের বাড়িতে থাকতে। কিন্তু যুথী রাজী হয়নি। দাদীর বাড়িতে সবার সাথে থাকতেই যে তার ভালো লাগে। আজ যুথীর ক্লান্তি দেখে পারভিন সেই পুরোনো কথার পুনরাবৃত্তি করল। বলল, ‘যুথী আপা, এই মাসটি অন্তত থাকেন। আপনার অনেক কষ্ট হয় এত দূর থেকে আসতে।’ যুথী হাসে, বলে, ‘আমার জন্য কেন এত মায়া পারভিন? আমিতো তোমার রক্তের সম্পর্কের কেউ নই।’ যুথীর কথায় পারভিনের চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে যেন। যুথী তা বুঝতে পেরে আলতো করে ওর গালে একটু চিমটি দিয়ে বলে, ‘পাগলী আমিতো ঠাট্টা করছিলাম। এই দুনিয়ায় আমরাতো সবাই আপন। শুধু পরিচয় নেই এই আর কি।’ এমন সময় ক্লাসের ঘন্টা পড়ে যায়। যুথী তাড়াতাড়ি ক্লাসে চলে যায়। পাশের ক্লাসে পারভিনও চলে যায়।
ঠিক একটায় স্কুল ছুটির পর ছাতা মাথায় আবারও বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে হাঁটতে থাকে যুথী। কাল শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটি। তাই আজ তার একটু ভালোই লাগে। খুব জোরে পা না চালিয়ে একটু আস্তে আস্তেই হাঁটতে থাকে সে। স্কুল ঘাটের ছোট্ট মুদি দোকানি রমিজ দাদা জোরে হাঁক ছেড়ে ডাক দেয় ‘এই যে মাষ্টারনি, কেমন আছো? তোমার দাদির জ্বালায় যে আর বাঁচিনা গো!’ যুথী হেঁসে বলে, ‘কেন, আবার কি হল, দাদির অসুখ সারেনি? রমিজ দাদা বলে, ‘তা সেরেছে তবে, তোমার কথা বলতে বলতে এবার আমায় অসুখে ফেলবে সে! তা যাওনা কেন একটি বার। গিয়ে দেখা করে এসো। নইলে আমি যে আর বাঁচিনে গো!’ যুথী বলে, ‘আজ না দাদা। দাদীকে বলেন শনিবার যাবো, কেমন? আর বলবেন, সেদিন কিন্তু আমি দুপুরে ভাত খাবো। কি দিয়ে বলেন তো?’ রমিজ দাদা ফোকলা হাসি হেঁসে বলে, ‘জানি মহারাণী, জানি। বৈরালী মাছ দিয়ে, তাইতো?’ যুথী হেঁসে বলে, ‘এইতো বুঝে ফেলেছেন। কথা শেষ করে হাঁটতে থাকে সে। ঘাটে এসে অপেক্ষা করে নৌকার।
প্রতিদিন বাড়ি ফেরার পথে এই অসুবিধাটা হয় যুথীর। অন্তত পনেরো মিনিট চৈত্রের এই কড়া রোদে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় নৌকার জন্য। এই ঘাটে একটি মাত্র ইঞ্জিন চালিত নৌকা। আর তাই এই সমস্যা। ঘাটের এক পাশে বালির উপর বসে পড়ে যুথী। আঁচল দিয়ে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে ফেলে। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে বেশ কিছুটা পানি খেয়ে ফেলে সে। বড় তৃপ্তি অনুভব করে। দূরে ভটভট শব্দে নৌকার আসার আওয়াজ কানে আসে তার।
নৌকা এসে ঘাটে ভীড়তেই হুর হুর করে লোকজন নামতে থাকে নৌকা থেকে। আজ একটু বেশিই ভীড় নৌকায়। হাটবার ছিল তাই। নৌকার মাঝি যুথীকে ভালই চেনে তাই সে তাড়াতাড়ি একটি পাটাতন তার কাঁধের গামছা দিয়ে মুছে বলে, ‘আসেন ম্যাডাম আসেন, বসেন। আজ হাঁটবার তো তাই একটু ভীড়।’ যুথী জানে হাটবারে বেশিই ভীড় হয়। তার পরও সে একটু হাসে। নৌকার ঠিক মাঝের একটি পাটাতনে বসে সে। ছাতাটি তার মাথার উপরই ধরা থাকে। প্রথম প্রথম যখন সে নৌকায় করে স্কুলে আসতো তখন কি যে এক অস্বস্তি লাগত তার! সারাদিন ভোঁ ভোঁ করে মাথা ঘুরতো। নৌকায় ওঠা তার অভ্যেস নেই। চোখ বন্ধ করে থাকতো যতক্ষণ না নদী পার হয়। নৌকার আর সব যাত্রীরা তার এই অবস্থা দেখে মুখ টিপে হাসতো। নৌকায় উঠলে যুথীর মনে হতো সমস্ত পৃথিবীটা যেন দুলছে আর এক্ষুণি পানিতে পড়ে যাবে সে! কিন্তু এখন নৌকায় উঠতে তার ভালই লাগে। এই সাত মাসে তার অনেক কিছুই অভ্যেস হয়ে গিয়েছে।
নৌকা ঘাটে ভীড়লে নেমে পরে সে। আবার হাঁটতে হবে অনেক দূর বলুচর। আঁচলে মুখটি মুছে নিয়ে আবারো হাঁটতে থাকে যুথী। বালুচরে হাঁটতে হাঁটতে ছোট বেলার কথা মনে পড়ে তার। সে যখন ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ে, তখন দাদা বাড়িতে বেড়াতে আসে তার এক ফুপুর বিয়েতে। ওজিফা ফুপু। তার বাবার ফুফাতো বোন। যুথীর মা-ই ছিলেন সেই বিয়ের ঘটক। শহর থেকে বেশ কিছু আত্মীয় এসেছিল সেই বিয়েতে। যুথীর সমবয়সি কজন মিলে নদীর চরে হাঁটতে গিয়ে তারা পথ হারিয়ে ফেলেছিল। চরের মাঝখান থেকে পাড়ের বাড়িগুলোকে একই রকম দেখতে লাগে। অবশেষে যুথীর ছোট চাচাই চরের তামাক ক্ষেত থেকে ফেরার পথে তাঁদেরকে সাথে করে নিয়ে আসে।
হঠাৎ মেঝো চাচার মেঝো মেয়ে শারমিন এর ডাকে ভাবনার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসে যুথী। শারমিন বলে ‘যুথী আপু, তোমার আজ এতো দেরী হল যে!’ যুথী হেসে বলে, ‘কেন রে, কী হয়েছে?’ শারমিন বলল, ‘না কিছু হয়নি, দাদী বলল তোমার আজ ফিরতে দেরী হচ্ছে তাই একটু এগিয়ে এসে দেখতে এলাম।’ যুথী শারমিন এর কাঁধে হাত দিয়ে দুজনে মিলে বাড়ি ফেরে।
তালা খুলে ঘরে ঢুকে টেবিল ফ্যানের সুইচটা অন করে ব্যাগটি আলনায় ঝুলিয়ে রেখে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে সে। স্যান্ডেলগুলো খুলে পায়ের দিকে তাকায় যুথী। বুড়ো আঙুল দুটোয় ফোস্কা পড়ে কেমন কালো দাগ পড়ে গিয়েছে তার! খুব কষ্ট হয় তার মনে! হাতের ঘড়িটি খুলে বাক্সর উপর রাখে। বাম হাতের যেখানটায় ঘড়ি পরে, সেইখানটায়ও ঠিক ঘড়ির মতই দাগ পড়ে গিয়েছে। রোদের তাপে যুথীর শরীরটা কেমন যেন তামাটে হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। বুক চীরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার! দাদীর ডাকে চমকে ওঠে সে। দাদী এখনো না খেয়ে বসে আছে তার জন্য। বিছানা থেকে উঠে পড়ে সে। আলনা থেকে শাড়ি, পেডিকোট, ব্লাউজ আর গামছা নিয়ে কল পাড়ে যায়। চটপট গোসল সেরে খেতে আসে রান্না ঘরে। দাদীসহ এক সাথে খেতে বসে। খেতে খেতে দাদীকে যুথী বুঝিয়ে বলে, ‘দাদী আমার জন্য রোজ এ ভাবে না খেয়ে থাকবেন না, কেমন? আপনি বুড়া মানুষ। তাছাড়া আপনার শরীরও খুব ভাল না। আপনি খেয়ে আমার খাবার টা আপনার ঘরে রেখে দিবেন।’ কিন্তু দাদী কিছুতেই যুথীর কথায় রাজি হয়না! বলে, ‘না, এক সাথেই খাবো আমরা।’ যুথী হাসে। খাওয়া শেষ করে ঘরে যায় সে। অনেক ক্ষুধা লেগেছিল আজ তার! খাবার পর শরীরটা মনে হচ্ছে চলছে না আর। বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে। ক্লান্তিতে চোখ দুটি তার বন্ধ হয়ে আসে। ঘুমিয়ে পড়ে যুথী।
আছরের আযানে ঘুম ভাঙে যুথীর। উঠে নামাজ পড়ে স্টোভে চায়ের পানি বসিয়ে দেয় সে। চা বানাতে গিয়ে দেখে চিনি শেষ হয়ে গিয়েছে। মনটা বড্ড খারাপ হয়ে যায় তার। আর এরই মধ্যে দাদী এসে যায় চা খাওয়ার জন্য। লজ্জায় যুথীর মুখটি পাংশু হয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে, ‘দাদী চিনি যে নেই, আমার মনেই ছিল না!’ দাদী বলে, ‘সমস্যা নাই, আমার কাছে কিছু গুড় আছে। আজকে না হয় আমরা গুড়ের চা-ই খাই। তুই চায়ে একটু আদা থেঁতলে দে। গুড়ের চা আদা দিয়ে খেতে বেশ মজা।’
দাদী বেরিয়ে গেল গুড় আনতে। যুথী আর নিজেকে সামলিয়ে রাখতে পারল না। চোখ দুটি তার পানিতে ভরে উঠল। মাত্র তিন হাজার সাতশত টাকার চাকুরী তার। চৈতি আর অনিক এর জন্য দু হাজার টাকা রেখে বাকি সতেরোশো টাকা দিয়ে তাকে চলতে হয় পুরো একটি মাস। খাওয়ার জন্য যদিও মেঝো চাচা কোন টাকা নেন না কিন্তু তারপরও মাঝেমধ্যে যুথী মাছ, মাংস, দুধ এসব কিনে দেয়। সকাল বিকাল চা, হালকা নাস্তা, সে তার নিজের ঘরেই সারে। কেরোসিন থেকে শুরু করে কাপড় কাচার সাবান, সব সে নিজেই কিনে নেয়। চৈতি ও অনিক শহরে যুথীর বাবার বাড়িতে থাকে।
অনিক যুথীর বড় ছেলে আর চৈতি ছোট মেয়ে। অনিক শহরে জেলা সরকারী স্কুলে নবম শ্রেণী আর চৈতিও সরকারী গার্লস স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে তাই পড়া লেখার খরচটা একটু কমই লাগে। থাকা খাওয়ার কোন টাকা না লাগলেও দুজনের জন্য প্রাইভেট মাষ্টার ও রিকসা ভাড়ার জন্য যুথী ওদের দু হাজার করে টাকা দেয় প্রতি মাসে। অনিক বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে। অনেক মেধাবী ছেলে। ক্লাস এইট এ বৃত্তি পেয়েছে জেলা স্কুল থেকে। চৈতিকে সে নিজেই পড়ায়। আর সে শুধু দুটি বিষয়ে প্রাইভেট পড়ে।
দুটি ভাই বোনে অনেক মিল। তাদের মাকে তারা খুউব বোঝে। আর বুঝবে না-ই বা কেন। ছোট বেলা থেকে যুথীর সঙ্গই যে তারা পেয়েছে বেশি। তাঁদের বাবা কখনোই তাদের সময় দিত না। তার ব্যস্ততা ছিল শুধু নিজেকে ঘিরেই। আর এখনতো তার চাইতে কম বয়সি এক মেয়ে বিয়ে করে আলাদা সংসার এ বেশ সুখেই আছেন তিনি। সন্তানদের সকল দায়িত্ব যুথীর উপর।
দাদীর ডাকে চমকে ওঠে সে। দাদী গুড় হাতে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বলে, ‘কী অত ভাবিস, বলতো?’ গোপনে আঁচলে চোখ মোছে যুথী। বলে, ‘কই, কিছু নাতো। ভাবছি কাল একটু শহরে যাব দাদী। প্রায় পনেরো দিন হয়ে গেল বাচ্চাদের দেখিনা।’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। উঠে গিয়ে দু কাপ চা বানিয়ে দাদী সহ মুড়ি দিয়ে খেতে খেতে আরো কিছুক্ষণ গল্প করে তারা। চা খাওয়া শেষে দাদী বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। যুথীও বাঁশের খুঁটিতে পেরেক দিয়ে আটকানো বেতের ছোট্ট আয়নাটিতে মুখ দেখে। মাথায় হালকা একটু চীরুনী বুলিয়ে হাঁটতে বেরিয়ে পড়ে। বাঁধের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে সে। আর ঘণ্টখানেক বাদেই সন্ধ্যা নামবে। তারপর রাত। হাঁটতে হাঁটতে যুথী তার সেই প্রিয় গ্রোয়িং বাঁধের উপর পৌঁছে যায়। বাঁধের রেলিং এ ঠেঁস দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। পূর্ব দক্ষিণ কোণ হতে অবিরাম হাওয়া বইছে। এলোমেলো চুলগুলো উড়ে উড়ে চোখে মুখে পড়ছে তার। দক্ষিণ মুখ হয়ে দাঁড়ায় সে। দু চোখ বন্ধ করে নদীর পানির কল কল আওয়াজ, বাতাসে ভেসে আসা কাদা-মাটির গন্ধ প্রাণ ভরে অনুভব করে। দূরে মসজিদে মাগরিবের আযান শুনতে পায় সে। বাঁধের একটু দূরেই হিন্দু বাড়ি থেকে ভেসে আসে মৃদু শঙ্খধ্বনি। চোখ খুলে ঘুরে দাঁড়ায় যুথী। চারিদিক অন্ধকারে ছেয়ে আসতে থাকে। হঠাৎ তার এই পরিচিত যায়গাটি অচেনা মনে হতে থাকে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন অজানা ভয়ে কাঁপতে থাকে। বাড়ির উদ্যেশ্যে পা বাড়ায় যুথী। হাঁটতে হাঁটতে ভাবে কাল শহরে যেতে হবে অনেক দিন বাচ্চাদের দেখে না সে।
আপনার মতামত লিখুন :