NarayanganjToday

শিরোনাম

লাল-নীল সংসার-১৮

ফেরদৌস কান্তা


লাল-নীল সংসার-১৮

বেশ্যাপাড়ায় ঢুকেই কেমন হতভম্ব হয়ে গেলো জাহিদ। চারপাশে নানানবয়সি মেয়ে আর মহিলারা চলাফেরা করছে। তাদের সবার চেহারার উৎকটে সাজগোজ খুব চোখে লাগছে। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। আবার কয়েকজন একসাথে বসে বসেও গল্প করছে। কেউ বা কারো হাত ধরে কিংবা সাথে করে পুরুষ নিয়ে ভেতরে চলে যাচ্ছে। কার কারও চোখে চোখ পরতেই চোখ টিপে দিচ্ছে। ভারি এক অস্বস্তিতে পরে গেলো জাহিদ। এ সে কোন জায়গায় এসে পড়েছে! নিরু এখানেই আছেতো! থাকলেও এদের মাঝে সে কিভাবে নিরুকে খুঁজে পাবে? তার তো সবার চেহারাই একইরকম মনে হচ্ছে! হায়! নিরু এই পরিবেশে! ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন খালি খালি বোধ হতে লাগলো।

হঠাৎ কারো হ্যাঁচকা টানে সম্বিৎ ফিরে পেলো জাহিদ। জোরে চিৎকার করে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো সে। এখন মাথা গরম করা যাবেনা ভাবল সে। যদিও ভেতরে এসে কিভাবে আগাবে তার পরিকল্পনা করেই এসেছিল, তবুও এই পরিস্থিতিতে আর অতটা মাথা ঠাণ্ডা রেখে মনে হচ্ছেনা সে আগাতে পারবে। পারতেই হবে, নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে নিজেকেই বুঝ দিলো জাহিদ, নিরুকে পেতে হলে সামনে আরও বহু ভেজাল সামলাতে হবে। শুরু করতেই হবে নইলে কিছুতেই নিরুর কাছে পৌঁছানো যাবেনা। নিরু এখানেই আছে, এটা ভাবতেই মনটা বেশ শান্ত হয়ে এলো জাহিদের। তার হাত ধরে টানছিল বছর পঁচিশের একটা মেয়ে। সে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে কোনরকমে হেসে বলল, ‘আপনি না, আমার কমবয়সী মেয়ে পছন্দ’। মেয়েটা শুনে খিলখিল করে উচ্চশব্দে হেসে উঠলো। জাহিদ রীতিমত সে হাসিতে লজ্জায় পড়ে গেলো। হাসতে হাসতেই কাকে যেন ডাক দিলো মেয়েটি। তারপর হাসতে হাসতেই জাহিদকে বলল, ‘এই পাড়াতে নতুন বুঝি? তাইতো মুখ দিয়ে আপনি বের হয়’! জাহিদ থতমত খেয়ে বলল, ‘না মানে হ্যাঁ’। মেয়েটা আবারো উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। যাকে ডাক দিয়েছিল সে এলো। ভালো করে তাকিয়ে দেখতেই জাহিদ বুঝল যে এলো সে মাঝ বয়সি মহিলা আর সম্ভবত মেয়েদের দেখে রাখার দায়িত্বে আছে। মহিলাটিকে জাহিদকে দেখিয়ে দিয়ে মেয়েটি বলল, ‘নতুন এসেছে দিদি, ভেতরে নিয়ে যাও। ভদ্দরলোক কমবয়সী মেয়ে চান’। বলেই আবার হাসিতে ঢলে পড়লো। মহিলাটি জাহিদকে, ‘এদিকে আসেন’ বলেই সামনে হাঁটা শুরু করলো।

জাহিদকে মহিলাটি একটা রুমে এনে বসালো, অপেক্ষা করতে বলে বেড়িয়ে গেলো। ভালো করে রুমের এদিক-সেদিক দেখছে জাহিদ। ভীষণ ছোট এই রুমটাতে একটাই দরজা আর একটাই জানালা। জানালাটা বন্ধ। জানালা আর দরজা দুটোতেই ময়লা আর স্যাঁতস্যাঁতে পরদা ঝুলছে। জানালার পাশেই একটা বিছানা পাতা আছে যাতে সস্তা দামের তেল চিটচিটে চাদর আর দুইটা বালিশ রাখা আছে। একটা টেবিল আর একটা চেয়ার রয়েছে বিছানার কোল ঘেঁষে। টেবিলে একটা পানির জগ আর একটা গ্লাস। দেয়ালে ঝাপসা একটা আয়না ঝুলছে। মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে বনবন শব্দ করে, তবুও মাথাটা ঘুরে উঠল। হঠাৎ জাহিদের খেয়াল হলো সে খুব ঘামছে। তাড়াতাড়ি চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো সে। অস্থিরতা পেয়ে বসেছে তাকে। ছটফট করে উঠছে মন এখান থেকে বেড়িয়ে যেতে দ্রুত, কিন্তু নিরুকে ছাড়া তো এখান থেকে যাবেনা জাহিদ। ভাবতে ভাবতেই দরজার ঠেলে দু’জনকে প্রবেশ করতে দেখল সে। একজন সেই মহিলাটি, আরেকজন সাথে বছর ষোল কিংবা সতেরোর একটি মেয়ে। প্রথম দেখায় মন প্রতিবাদ করে উঠল এতো তার নিরু নয়! চিৎকার করতে মন চাইল খুব নিরুর নাম ধরে যাতে নিরু শুনেই বেড়িয়ে আসে! হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে সামলে নিল কোনরকমে। এখন কোন ভুল করা যাবেনা, তাহলে আর কোনদিনই নিরুকে খুঁজে পাওয়া হবেনা। মহিলা জানতে চাইল, ‘চলবে নাকি আরও ছোট লাগবে? এরচেয়েও কমবয়সী চাইলে রেট বেশি পরবে’। জাহিদ হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়তেই মহিলা দরজা টেনে দিয়ে চলে গেলো।

মনে মনে কি কি কথা বলবে মেয়েটির সাথে জাহিদ ভেবে নিতেই দেখল, মেয়েটি নিজেই দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে হাসিহাসি মুখে তার দিকে এগিয়ে আসছে। জাহিদের একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হাতটা ধরে টেনে নিয়ে বিছানায় বসাল। জাহিদও হাসার চেষ্টা করছে। জাহিদ কিছু বলার আগেই কথা বলে উঠল মেয়েটি, ‘আপনি এখানে প্রথম আইলেন? আগে আর কোনদিন দেখি নাই আপনেকে।’ জাহিদ হাসিমুখেই জানতে চাইলো, ‘তোমার নাম কি? এখানে কতদিন হয় আছো?’ যেন খুব একটা মজার কথা শুনেছে, প্রশ্ন শুনেই হাসিতে ফেটে পরল মেয়েটি। হাসতে হাস্তে বিষম খেলো যেন! তারপর, হাসতে হাসতেই মুখে কাপড় চেপে ধরে বলল, ‘যে কামের জন্য আসছেন, সেইটা সারেন মিয়া, আমাদের কোন নাম-ঠিকানা থাকেনা। আমাদের নাম বেশ্যা আর ঠিকানা এইটাই’। কথা শেষ করেও হাসতে থাকলো মেয়েটি। জাহিদ হাসিমুখে বেশ দৃঢ়তার সাথেই উত্তর দিলো, ‘কিন্তু আমার যে তোমার নাম ঠিকানা লাগবে, সাথে আরও একজনের। যাকে আমি পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছি’। জাহিদের চোখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটির হাসি থেমে গেলো। ভয় পাওয়া গলায় বলে উঠল, ‘কে আপনে’? (চলবে)

উপরে