NarayanganjToday

শিরোনাম

লাল-নীল সংসার-১৯

ফেরদৌস কান্তা


লাল-নীল সংসার-১৯

ভয়ার্ত কণ্ঠে পুনরায় মেয়েটি জানতে চাইলো, ‘কে আপনে’? জাহিদ বললো, ‘আমি মানুষ, আরেকজন মানুষের খোঁজে এসেছি’। মেয়েটি একথা শুনে যেন ভয়ে ককিয়ে উঠল। প্রায়ই কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘আপনি যেই হন এখান থেকে  যান গিয়ে। অরা আপনাকে মাইরা ফেলবো। এইখানে যে ঢুকে সে একেবারেই হারায়া যায়। তারে আর কোনদিন কেউ খুঁইজা পায়না। এইটা নর্দমা। এইখানে আইসা পরলে আর কারো কোনদিন কোনদিকে যাবার উপায় থাকেনা। একমাত্র কেউ এইখানে মরলে পরেই মুক্তি পায়’। ‘কারা মেরে ফেলবে আমাকে’, জানতে চাইলো জাহিদ। বলে চলল সে, ‘আগে তুমি আমার কথা শুনো। আমার নাম সুজন। আমি ঢাকায় থাকি। আমার খুব কাছের প্রিয় মানুষটাকে মাস দুয়েক আগে কিছু অমানুষ জোর করে ধরে এখানে এনে বন্দী করে রেখেছে। আমি তাকে খুঁজতে খুঁজতেই তোমাদের এখানে এসে পড়েছি। আমি জানি সে এখানেই আছে। আমি সমস্ত কিছু জেনে, খোঁজ নিয়ে তারপরই এখানে এসেছি তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে’। একনাগাড়ে কথাগুলি বলে থামল জাহিদ। মেয়েটি যেন অবাক হতেও ভুলে গেছে এমনি ভাবে জাহিদের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর ক্ষীণ কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘অরা ভয়ানক নিষ্ঠুর, জানতে পারলে আপনে ক্যান আসছেন এখানে জানে মাইরা আপনের লাশ গায়েব কইরা ফেলবে। আপনে যান গিয়া এখুনি’। জাহিদ কথার পিঠেই জানতে চাইলো, ‘বলো এই ওরা কারা? সেলিম আর রফিক তো’? মেয়েটি এবার উঠে রুম থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে যেতে চাইলো। তার আগেই জাহিদ উঠে ওকে টেনে এনে বিছানায় ফেললো। পকেট থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট মেয়েটিকে বাড়িয়ে দিলো। বলল, ‘এটা রাখো তোমাকে দিলাম। এটা তোমার ইনকামের বাইরে এক্সট্রা দিলাম আমি। তোমার কোন ক্ষতি হতে দেবনা আমি। তোমাকেও এখান থেকে উদ্ধার করবো কথা দিলাম। তুমি শুধু আমাকে সাহায্য কর। সরাসরিও সাহায্য করতে হবেনা। তুমি যেহেতু এখানে আছো নিশ্চয়ই জানো নতুন কে কে আসে এবং তারা কোথায় আঁচে এখানেই’। মেয়েটি টাকাটা নিয়ে বুকে ব্লাউজের ভেতর ঢুকিয়ে রাখল। এখন সে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে।

জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে মেয়েটি ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। তারপর বড় করে একটা শ্বাস টেনে বলল, ‘ আমারে অরা কিছু করবে নাতো? তাইলে আপনেকে আমি সব বলমু’। জাহিদ আবারও বলল, ‘তোমার কোন ভয় নাই। আমি কথা দিয়েছি তোমার কোন ক্ষতি হবেনা। তুমি শুধু আমাকে নিরুর কাছে পৌঁছে দেবে’। ‘নিরু’? জানতে চাইলো মেয়েটি। ‘হ্যাঁ, আমি যাকে খুঁজছি ওর নাম নিরু। পনের ষোল বছর বয়স ওর, অনেকটা তোমার মতনই দেখতে। মাস দুয়েক হয় ওকে গাজিপুর থেকে জোর করে উঠিয়ে এনেছে তোমাদের সেলিম আর রফিক। আমি ওর খোঁজেই আজ এখানে এসে পৌঁছেছি। এবং আমি নিশ্চিত জেনেই এসেছি যে নিরু এখানেই আছে’। একটু থেমে আবার জাহিদ জিগ্যেস করলো, ‘এখন কি তুমি আমাকে তোমার নাম বলতে পারো’?

করুণ হাসি ফুটে উঠলো মেয়েটির চোখেমুখে। অনেক দূর থেকে যেন ভেসে এলো কণ্ঠস্বর! ধীর লয়ে বলতে লাগলো, ‘বাবায় ছোট বেলায় আদর কইরা ডাকতো পরী, আম্মায় ডাকতো লালি। আমার ছোট দুইটা ভাই ছিল, জামাল আর কামাল। গ্রামের নাম আছিল সোনাডাঙ্গা। আর কিছুই মনে করতে পারিনা আমি। দশ বছর বয়সে হারায়া গেছিলাম গঞ্জের মেলায় বাবার লগে গিয়া। কিচ্ছু মনে নাই আমার, এক সকালে ঘুম ভাইঙ্গা দেখলাম আমি এইখানে। কতো চিৎকার করছি, কতো কানছি! কেউ শুনে নাই সে কান্না আর চিৎকার! বেশি কানলে খাবার বন্দ কইরা দিত দুই এক দিনের জন্য। খিদার জ্বালায় আস্তে আস্তে কান্দন ভুইলা গেছি। একদিন রুমে বেডা ঢুকাই দিছে। তারপর আগের আমি শেষ আর এই নতুন আমার জন্ম। আমার নাম এইখানে শেফালি আর এখন তো আমি জানি এই জায়গাতেই আমার মরণ লেখা অন্য সবার মত’!

মেয়েটির কথা শুনতে শুনতে জাহিদের চোখ দুটি ভিজে উঠল। বলল, ‘আমি তোমাকেও এখান থেকে নিয়ে যাব, কথা যখন দিয়েছি সেটা রাখবোই’। মেয়েটি হেসে উঠল, মেয়েটির চোখে পানি চিকচিক করছে। বলল, ‘যার খোঁজে আসলেন তারে আগে নিয়া যান দেখি আমি। আমারে নেয়া লাগবো না। আপনি যারে খুঁজতেছেন তারে এইখানে নতুন নাম দিছে চম্পা। মাইয়াডাও আমার মত বহুতদিন কানছে দিন-রাত। কিন্তু লাভ হয় নাই। এইখানে কাইন্দা কোন লাভ হয়না। দিন পনের পর হইতেই অরে কামে লাগায় দিছে। এইখানে কমবয়সী মাইয়ারা চলে বেশি। তাই চম্পার দাম ভালোই উঠে’। জাহিদের চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠে মেয়েটির কথা শুনতে শুনতে। রাগে বিছানার উপর জোরে ঘুষি মেরে বসে সে। সাথে সাথেই দরজায় কে যেন বারি দেয়া শুরু করে, মোটা খ্যেরখ্যেরে গলায় জানতে চায়, ‘কিরে কি হইতাছে? শেষ হয় নাই এখনো? বাইর হ তাড়াতাড়ি। কাস্টমর অপেক্ষায় আছে’।  ভীত গলায় মেয়েটি উত্তর দিলো, ‘কিছু হয় নাই, আইতাছি, প্রায় শেষ’। জাহিদের দিকে তাকায়ে বলল, ‘আপনে আজকে যানগা। কাইল আইসেন। কেউ টের পাইলে খুন হইয়া যাইবেন, কেউ লাশ ও খুঁইজা পাবেনা’। জাহিদ গোঁয়ারের মত জবাব দিলো, ‘আমি নিরুর সাথে দেখা না করে এখান থেকে যাবনা’। মেয়েটি অস্থির গলায় বলে উঠল, ‘আপনার কিছু হইলে আপনের নিরুরে আর পাইবেন না কিংবা অরা বুঝতে পারলে নিরুরেই মাইরা ফালাইব। আজ গিয়া কাল আইসেন। আমারেই খুঁজবেন। আমি শরীর খারাপ লাগতাছে কইয়া চম্পারে আপনার কাছে পাডাইতে কমু। যান এখন, একবার সন্দেহ করলে আর কিছুই করতে পারবেন না এখানে’। মন না মানলেও জাহিদ ভেবে দেখল মেয়েটি ঠিক কথাই বলেছে। অস্থির লাগলেও এখন কোন ভুল পদক্ষেপ নেয়া যাবেনা। ঠাণ্ডা মাথায় আগাতে হবে। এতো কাছে এসেও নিরুর সাথে দেখা না করে ফিরে যেতে একদমই মন চাইছে তার। কিন্তু কিছুই করার নেই, কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। ফোনে ভাইব্রেশন হতেই হাতে নিয়ে দেখল রিপন ফোন করেছে। কেটে দিয়ে ম্যাসেজ দিল, ‘বের হচ্ছি, ওয়েট কর’। তারপর শেফালিকে বলল, ‘আমি যাচ্ছি আজ। কাল ঠিক আজকের সময়েই আসব। যদি পারো নিরুকে একটু বলো আমার কথা। তবে তা খুবই সাবধানে, কেউ যেন টের না পায়। ওকে বলবে, জাহিদ এসেছিল ওকে নিয়ে যেতে। ও আমাকে জাহিদ নামেই চিনে। তোমার মত আমিও এখানে অন্য নামে পরিচিত হতে চাই, তাই তোমাকে সুজন বলেছিলাম আমার নাম। বলবে যে করেই হোক আমি ওকে এখান থেকে নিয়ে যাবোই এবং তা খুব তাড়াতাড়ি’। একথা বলেই দরজা খুলে বের হয়ে গেলো জাহিদ।   (চলবে)

উপরে