NarayanganjToday

শিরোনাম

বাবার অপেক্ষায় থাকা মেয়েটার সাথে দূরত্বটা আদর্শের


বাবার অপেক্ষায় থাকা মেয়েটার সাথে দূরত্বটা আদর্শের

আমি বাপ মায়ের অযোগ্য সন্তান। তাদের কোন স্বপ্নই আমি পূরণ করতে পারিনাই। ডাক্তার হইতে পারিনাই, বিসিএস দিইনাই, ভদ্র-ধার্মিক-সাংসারিক মেয়ে হইনাই। গলার কাঁটা আজীবন। আব্বা প্রায়ই বলতো, তুই এমন, যারে ফেলাও যায়না, গেলাও যায়না। কথা খুবই সত্য। সকল সম্পর্কে আমি বরাবর গলার কাঁটা প্রমাণিত হইসি। যারে দোষ দেওয়াও যায়না, আবার দোষ না দিয়াও থাকা যায়না।

আমার আব্বা লোকটার আর্লি লাইফ খুব স্ট্রাগলের। তিনমাসে বাপ মরলো কলেরায়। মায়ের বয়স কম বলে বিয়ে হয়ে গেলো আবার। বড় হতে থাকলো নানী বাড়িতে। নানা ডাকতো ‘হুমাইন্না’ মানে সম্ভবত ‘আশ্রিত’। তবু নানী আর মামাদের কোলে, কিছুটা অভাব অথচ দূরন্ত শৈশবে সে খারাপ ছিলোনা। বরিশালের অগুণতি খালগুলোতে মাছ ধরে, দৌঁড়ঝাপে খুশি ছিলো সে। পাঠশালা শেষ হবার পর চাচা নিয়ে গেলো খুলনায়। নিঃসন্তান চাচী তখন মা-ই হয়েছিলেন হয়তোবা তার কাছে। খালিশপুর জুটমিল কলোনীতে স্কুল কলেজ জীবন শেষ করতে লাগলো হিমু। সাইকেল চালিয়ে, হেঁটে বহু পথ পাড়ি দিয়ে স্কুল কলেজে যেতে হতো। বাথরুমেও লাইন দিতে হতো৷ গরমে ঘরে ঘুম না হলে ঘুমাতে যেতে হতো মসজিদে। এরমাঝেও বই পড়তো হিমু। নাটকের দল করতো। যুব সংঘ করতো। আবৃত্তি করতো। স্কাউটিং করতো। নজরুলের গান লিখে লিখে খাতা ভরতো। হিমুর গায়ের রঙ কালো। সবাই খোটা দিতো। তবু সেখানে কৈশোরের তেজ চিকমিক করতো।  হিমু। আমার আব্বার ডাকনাম।হেমায়েত থেকে হিমু।

এরমাঝে প্রেম আসে জীবনে। বড় খালার ছোট মেয়ে জাহিরুন। যে হবার পর নানী কোলে নিয়ে বলেছিলো, এই সুন্দর মেয়েটাকে হিমুর বৌ করে আনবার কথা। ছোটবেলা থেকেই তাই জাহিরুনকে হিমু আর বোন ভাবতে পারেনা। ভাবে বউ। জাহিরুন প্রথমে হালকা নিমরাজি হলেও হিমুর কাব্যময় চিঠি আর অমোঘ আবেগের কাছে পরাজিত হয়। প্রেম চলে। ঢাকা টু খুলনা। চিঠির প্রেম। ঈদ পার্বণে হয়তো অল্প দেখা। এই। অথচ শপথ ছিলো দৃঢ়।

সেই শপথেই গ্রাজুয়েশন করতে চলে আসে হিমু ঢাকায়। মামার বাড়ি। সেখানে ফুট ফরমায়েশ খাটার বদলে আশ্রয় মেলে। মামীটা নিতান্তই ভালো লোক ছিলো বলে শত কাজেও মন খারাপ হতোনা। কম খেয়ে কম পরে স্বপ্ন দেখে বড় হয়ে গেলো। পড়াশোনা শেষ হলো।

এতিম এবং গরীব হিমুর সাথে জাহিরুনের বিয়ে কেউ-ই দিতে চায়নি। কিন্তু প্রেমের কাছে মাথা নোয়াতে হলো সবার। ছোট চাকরি নিয়ে খুলনা ঠাকুরগাঁও ঘুরে স্থায়ী হলো ঢাকায়। সরকারী চাকরি হলো। একটা মেয়ে হলো। তখন বেতন খুব কম। মেয়ে বুকের দুধ খায়না। হাতের প্রিয় ঘড়ি বিক্রি করতে হলো। ঢাকায় এসে সাবলেট থাকতে হলো বউ এর ভাইদের সাথে।

ধীরে ধীরে বেতন বাড়লো। টাইপ করে বাড়তি কিছু উপার্জন করা, ২৫ বছরেই বাপ হয়ে যাওয়া ছেলেটা এককালে ঢাকায় বাড়ি গাড়িও করে ফেললো। তারে তিরস্কার করা লোকজন এরপর তার কাছেই বহুবার সাহায্যের জন্য এসেছে।

তিন সন্তানের জনক সে। কাউকেই মন মতো মানুষ অবশ্য করতে পারে নাই। পা ভেঙে ক্র‍্যাচ নিয়ে বেড়াচ্ছে ক'বছর হলো। একা হাতে আর্থিক বিষয়াদি সামলে বয়সের চেয়েও বেশি বয়েসী দেখায় এখন তাকে। ডায়েবেটিকস, ব্লাড প্রেশার বাঁধিয়েছে দুঃশ্চিন্তায়।

বরিশালের ছেলেরা স্বভাবতই রাগী। আমার বাপ তার ব্যতিক্রম নয়৷ প্রচুর মার খেয়েছি তার হাতে। এমন কিছু নাই যা দিয়ে পেটায় নাই। দুধ কেন খাইনা থেকে শুরু করে আম্মার মুখের উপর কথা বললাম ক্যানো সব ইস্যুতেই পিটিয়ে লাল বানিয়েছে গা হাত পা। কখনো কখনো নিজে এসেও মলম টলম লাগিয়েছে পরে। তবে তীব্র পুরুষতান্ত্রিকতা আর ধর্মান্ধতার মধ্যে বেড়ে ওঠা আব্বা বয়সের সাথে সাথে প্রগতিশীল চিন্তাদের অনেকটাই পেছনে ফেলে এসেছেন। সকলের প্রতি সহমর্মিতা থাকলেও ভেতরে কিছু গোড়া মনোভাব জন্মেছে সামাজিক চাপে।

আমি আব্বারে ভালোবাসছি। জন্মের পর থেকে। যখন অফিস থেকে ফিরে সে আমারে ঘুঘুতে, তালগাছে চড়াতো। যখন গল্প শুনেছি এক ভয়ানক বাস এ্যক্সিডেন্টে সে কিভাবে আমারে বুকের ভেতর রেখে বাঁচিয়েছে। যখন দেখেছি সেও আমার মতোন ছোটমাছ, ভর্তা আর গরুর মাংস ভালোবাসে। জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে তীব্র আপত্তি থাকার পরেও সে তার এই বখে যাওয়া বড় মেয়েকে ফেলতে পারে নাই। মাথার ওপর ছাদ দিয়ে গেছে নিজ পায়ে দাঁড়ানো অবধি। সমাজের অনেক কটু কথা শুনেছে আমার জন্য। চোদ্দগুষ্টির একমাত্র বেয়াদব মেয়ের বাপ হয়ে তার আক্ষেপ একপাশে রেখে ‘কি করবো? মেয়েকে তো ফেলতে পারিনা’ বলে ঠাঁই দিয়ে ঋণী করেছে খুব।

আব্বার সাথে আমার তেমন ছবি নাই। রাগারাগি মারামারি করেই তো কূল পাই নাই আজীবন দুইজন। ছবি তুলমু কখন! আগে বাবা দিবসে টুকটাক গিফট দিতাম, চিঠি দিতাম। তারপর দূরত্ব খুব বাড়লো। সেই ছোটবেলায় আব্বু কখন আসবে ভেবে জানলায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা পর হয়ে গিয়েছে অনেক সময় এবং আদর্শের ব্যবধানে।

সে যেমন তার দায়িত্ব আজীবন পালন করেছে রাগ বিরক্তি থাকার পরেও; আমার উপর যদি কোন দায়িত্ব এসে বর্তায়, কিছু অভিমান দিব্যি ভুলে গিয়ে আমিও সব পালন করবো, এইটুক কৃতজ্ঞতাবোধ আমার আছে।

উপরে