NarayanganjToday

শিরোনাম

পৃথিবীর সব বাবারা ভালো থাকুক


পৃথিবীর সব বাবারা ভালো থাকুক

তখন হাইস্কুলে পড়ি। সেদিন সন্ধ্যায় হাতে মেহেদী দিচ্ছি, তখন বাবা বাইরে থেকে ফিরলো। কিছু একটা নিয়ে মেজাজ খারাপ, পড়া রেখে আমি মেহেদী দিচ্ছি দেখে ধমক দিয়ে বললো, মেহেদী ধুয়ে এক্ষুনি পড়তে বস। আরো বললো, পড়াশুনা নেই শুধু মেহেদি দেওয়া, বাগান করা, কালই সব গাছ উপড়ে ফেলবো। বলে রাখা ভালো, ফুল, গাছ, পাখি আমার ছোটবেলা থেকেই খুব প্রিয়, আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু এরা।

আমি যেনো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, যে বাবা আমাকে তুমি থেকে তুই বললে আমার চোখ উপচে জল পড়ে, সেই বাবা আমাকে ধমকাচ্ছে, আমার শখের বাগান, গাছ সব উপড়ে ফেলবে বলছে!

সেদিন একটুও কাঁদিনি, বেশি কষ্টে কাঁদতে পারছিলাম না। হাত ধুয়ে বই নিয়ে বসেছি, তবে পড়া হয় নি আর। মনে মনে ঠিক করলাম, যে বাগানের জন্যে বাবা আমাকে বকলো সে বাগানই রাখবো না। এ যেন একটা কষ্ট দিয়ে আরেকটা কষ্টকে লাঘব করার চেষ্টা।

খুব সকালে উঠেই বাগানে গিয়ে এক এক করে গাছ উপড়ে ফেলছি। গাছ কাটছি আর চোখ মুছছি। মা এই কান্ড দেখে বললো, রাগের মাথায় কি বলেছে আর উনার সব গাছ কেটে ফেলা লাগবে, পড়া বাদ দিয়ে এসবই করো তুমি! আমার রাগ আর গাছ কাটার গতি আরো বাড়তে থাকলো। বাবাও বাগানে এসেছে, ততোক্ষণে গাছ কাটা শেষ প্রায়। বাবা বুঝতে পেরেছে রাগের মাথায় যা বলেছে, যেভাবে বলেছে সেটা আমাকে খুব আঘাত করেছে।

বাবা এসে আমার কাছে দাঁড়ালেন, মাথায় হাত দিয়ে বললেন আর এমনটা বলবে না কখনো, আর যেন গাছ না কাটি, বাগান থাকুক। আমি তখন হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলাম, কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলাম, আমার বাগান আমি যা ইচ্ছে করবো, আমার গাছ আমি সব কেটে ফেলবো। আমি আর পড়া রেখে বাগানে এসে দাঁড়াবো না, এবার তুমি খুশি তো! বাবা তখন মন খারাপ করে চলে এসেছে বাগান থেকে। মনে আছে, সেদিন বাবা কত কি করলো আমার রাগ ভাঙাতে, তবে বাপ সোহাগী কিশোরী মেয়ের রাগ ভাঙানো কি এতো সহজ বাবার জন্যে!

তখন ২০০৪ সাল, সেদিন বাবা প্রথম আমাকে হোস্টেলে রেখে আসতে গিয়েছিলো, কত কি বলে আমাকে ভুলিয়ে রাখছে সেদিন, ছুটি হলেই এসে আমাকে নিয়ে যাবে, প্রতি সপ্তাহে আমাকে দেখতে আসবে। মনে আছে, বাবা যখন আমাকে হোস্টেলে রেখে চলে আসতে লাগলো, তখন গেইটের দুপাশে আমরা বাপ-বেটি দুজন মানুষ কোনো কথা বলতে পারি নি, শুধু চোখ মুছে গেছি নিরবে। কোনো কথা না বলেও ঠিক যেন বুঝতে পারছিলাম দুজনেরই বুকের ভেতরটা কতটা ভাঙছে!

ঘুম ভেঙেই যে মেয়েটা তার বাবাকে একটু সময়ের জন্যে হলেও জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতো সে মেয়েটা আজ থেকে একদম একা থাকবে, ঘুম ভেঙেই আর বাবাকে জড়িয়ে ধরা হবে না। আমাকে যখন কেউ জিজ্ঞেস করে আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্ত কোনটা, আমার সেই দিনটার কথা মনে পড়ে, গেইটের দুপাশে দাঁড়ানো দুজন মানুষের বিষন্ন মুখ মনে পড়ে।

২০১৮, গতবছর। দুঃসময়ের মাঝেও বাবার সাথে কাটানো সবচেয়ে সুখের, শ্রেষ্ঠ সময় আমার। তখন বাবা হাসপাতালে, সেই সময়টা আমি সবসময় ছিলাম বাবার কাছে, বাবা জানা, অজানা কতো কি গল্প করেছিলো তখন আমার সাথে! বাবার মুখে সম্পর্কের গভীরতার গল্প অবাক হয়ে শুনেছি সেদিন। মা-বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা, বন্ধুর প্রতি বন্ধুর নির্ভরতা, শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের শ্রদ্ধাবোধ, আরো কত, আরো কত কি!

বাবাকে নিয়ে হাজারো গল্প আছে, অনুভূতি আছে, যা বলে শেষ করা যাবে না। একটা বলতে গেলে আরো অনেকগুলো সামনে এসে দাঁড়ায়। শুধু এইটুকুই চাওয়া.. পৃথিবীর সব বাবারা ভালো থাকুক।

উপরে