বিষয়:
প্রকাশিত: জুন ১৬, ২০১৯, ০৬:৪২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১৬, ২০১৯, ১০:৪২ পিএম
নারায়ণগঞ্জ টুডে
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১৬, ২০১৯, ১০:৪২ পিএম
নারায়ণগঞ্জ টুডে
কাবিনের দিন আমি আমার বরকে জিজ্ঞেস করছিলাম- আচ্ছা, জামালপুরের পথে কি কালীহাতি পড়ে? সে বলছিলো, পড়ে কিন্তু সেই রোডে তারা যায় না, জ্যামের জন্য। আমি তাকে অনুরোধ করছিলাম, যাতে আমারে সেই পথেই শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়।
আমার আব্বু থাকে কালীহাতি। শেষ যেদিন আব্বু আমাদেরকে ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ডে একটা বাসে উঠায়ে দিলো- সেদিনও জানতাম না যে, এইভাবে আর কোনোদিন আমাদের দেখা হবে না। আব্বু-আম্মুর সেপারেশনের পর আম্মু আর আমাকে দেখা করতে দেয় নাই আব্বুর সাথে। আম্মুর মনে হইতো- আব্বু আমারে লুকায়ে নিয়ে যাবে। এইজন্য স্কুল থেকে বাসা, কঠিন পাহারায় আমারে আনা নেওয়া করা হইতো। আমার একা একা কোথাও যাওয়া নিষেধ ছিলো।
কিন্তু, আমি মনে মনে অনেক জায়গায় চলে যেতাম। চোখ বন্ধ করে মুক্তারপুর, তারপর ফেরিতে ওই পাড়ে। এরপর বাস নিয়ে গুলিস্তান- তারপর মহাখালী। মহাখালী থেকে টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ড। বাস থামলেই কল্পনায় দেখতাম, আব্বু দাঁড়ায়ে আছে, পরনে এ্যাশ কালারের ফতুয়া। সে ভিড়ের মধ্যে হাত বাড়ায়ে আছে, বলতেছে- ওই বাসে সিট রাখছি, তাড়াতাড়ি আসো। মনে মনে সেই বাসটায় উঠে দেখতাম- দরজার সামনের সিটেই একটা অ্যাশ কালারের ফাইল। সিটে বসার সাথে সাথে একটা ফ্রক পড়া মেয়ে দেখতাম বাঁকা হয়ে দাঁড়ায়ে- তার কোমরে সিলভারের জগ আর অন্য হাতে পোড়াবাড়ির চমচম। কল্পনাতেও (বাস্তবের মতো) আব্বু দুইটা চমচম কিনতো, চারকোনা পেপারের টুকরায় দুইটা পিস্ চমচম নিয়ে আমার মুখের সামনে ধরতো। মনে মনে সেই মেয়েটার সিলভারের জগের পানি খেতে গিয়ে জামা ভিজায়ে ফেলতাম তাড়াহুড়ায়।
আমার আম্মু-আব্বুর সাথে আর কখনো কালীহাতি যাওয়া হয় নাই। তারপরও চোখ বন্ধ করে ঠিক ঠিক দেখতাম একটা ব্রিজ- এরপর একটা বয়লার। চোখ বন্ধ করে বড় শ্বাস টানলে সেদ্ধ ধানের গন্ধ, এরপর হাজী ম্যানশন। আমরা তিনজন নামতাম, মনে মনে নামতাম- দেখতাম আব্বু তালা খুলতেছে, তার হাত কাঁপতেছে- সে ঠিকমত চাবি ঢুকাতে পারতেছেনা।
আমি আগে কখনও বুঝতে পারি নাই যে, আমার জামালপুরেই বিয়ে হবে। প্রথম শ্বশুরবাড়ি গেলাম ট্রেনে, এরপর বারবার সেই ট্রেনেই। বাইরোডে গেলেই কী! আমার আব্বু তো আর সেখানে থাকেনা- আসলে আমি জানিই না আব্বু কই। তারপরও ভাবলাম একবার হাজী ম্যানশনে নামবো।
মনে মনে না, একদিন সত্যিই সেই কালীহাতির ব্রিজ পার হয়ে বয়লারের ধানের গন্ধ নিতে নিতেই হাজী ম্যানশনে থামলাম। গাড়ি থেকে নামতেই বাড়িওয়ালা হাজী মামার সাথে দেখা- এতো বছর পর, অথচ আমি তারে কেমনে চিনলাম, তা জানিনা। আমি রাস্তার মধ্যেই তারে পা ছুঁয়ে সালাম করলাম, সে আমার দিকে তাকায়ে বললো- পুপ্পু! আমার বর তাকায়ে আছে, অচিন দেশের অচিন এক মানুষ আমার নাম জানে- এতো বছর পর কেমনে সম্ভব!
আমি হাজী মামারে বললাম, মামা! আমি এই পথে যাইতেছিলাম- কেন নামলাম জানিনা। আমি কেমনে চিনলাম তাও জানিনা।
মামা বললেন, তুমি আসো। সে হাত ধরে নিয়ে গেলেন আমারে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আব্বু সেই ঘরটাতে চকীর উপর বসা। তার সামনে একপ্লেট বিরই চালের খিচুরী। আমি আব্বুরে বললাম, আমি পুপ্পু। আব্বু অবাক হইলো না- আমারে পাশে টেনে বসায়ে টিভির দিকে আঙুল দিয়ে দেখাইলো... এইযে দেখো রেট্যেল স্নেক, ঝুনঝুনি ওয়ালা সাপ।
আব্বুরে দেখে মনে হইলো- এই যে আমি কত যুগ পর আসলাম এইটা মিথ্যা। মনে হইলো, ওই যে আমি কল্পনায় আসতাম ওইটাই সত্যি।
আব্বু বললো, তোমার আম্মু কই?
আমি বললাম, আম্মুতো আসে নাই।
আব্বু বিশ্বাস করলো না। বাইরে গেলো, আম্মুকে গাড়িতে খুঁজলো।
আমার অবাক লাগতেছিলো। সত্যিই আমি আমার আব্বুকে খুঁজে বের করে ফেলছি! ততক্ষনে পুরা এলাকায় খবর হয়ে গেছে, যে আমি আসছি। এর মধ্যে প্রফেসর চাচা আসলেন, বললেন- সে আর আব্বু মিলে প্রতি বছর আমার জন্মদিনে কেক কাটেন। তারিখও উল্লেখ করলেন- ১৯ জুলাই। আমি ততক্ষণে কান্নাকাটি শুরু করে দিছি। আমার কান্না এলাকাবাসীর মধ্যেও সংক্রামিত হয়ে গেল। হাজী মামার মেয়ে সুফিয়া কানতেছে, তার কোলের বাচ্চাও কানতেছে।
আমি সেই ঘরটার দিকে দেখলাম, সেই জানালা- পাশে বাঁশ ঝাড়। মনে পড়লো, প্রতিরাতে আমি আব্বু আম্মুর মাঝখানে ঘুমায়ে সকালে উঠে দেখতাম জানালার পাশে চলে গেছি। প্রতিদিন সকালে উঠে ঝগড়া করতাম- কেন তারা আমারে মাঝখান থেকে সরায়ে দিছে। মনে পড়লো, আব্বু বলতো- 'মা, তুমি তো মাঝখানেই শোও... কিন্তু বাঁশঝাড়ের ছোট্ট পরীটা তোমাকে জানালার পাশে নিয়ে যায়- চাঁদ দেখতে বলে।'
এই ঘরটায় কত স্মৃতি আমার! শেষদিকে মনে হইলো এখানেই থেকে যাই, আব্বুও বললো একরাত থেকে যেতে, কিন্তু...
ফিরে আসার আগ মুহূর্তে আব্বু আমার হাত ধরলো, দরজার কপাটের পেছনের দেয়ালটার কাছে নিয়ে গেল। আমি দেখলাম, দেয়ালটায় লেখা আছে-- শিরীন প্লাস মাজেদ (শিরীন+মাজেদ। আব্বু লাজুক গলায় বললো, হাসানের (আমার ছোট মামা) কাজ। ও আসছিলো একবার তোমার আম্মুর সাথে- তারপর...।
আব্বু বললো, প্রতি বছর আমি ঘর রং করি- ওইটুক জায়গা বাদ দিয়া। আমার হাসি পাইলো (কেন জানি আমার হাসির জায়গায় কান্না আর কান্নার জায়গাতেই বেশী হাসি পায়)। মনে হইলো, পৃথিবীর বড় প্রেমগুলি বিচ্ছেদী প্রেম... আর বিচ্ছেদী প্রেম বইলাই সেইটা 'বড়প্রেম'।
আপনার মতামত লিখুন :