NarayanganjToday

শিরোনাম

প্রাপ্তি


প্রাপ্তি

শেষ কবে মেলায় গেছেন মনে করতে পারেন ? রঙ বে রঙের  বেলুন;  হাওয়ায় উড়তে থাকা পতঙ্গা বা ঘুর্নি, একরাশ শিশুর উজ্জ্বল মুখ। বেলুন, জিলিপি, খেলনা... রান্নার খুন্তি থেকে মাথায় লাগানোর ক্লিপ... হরেক মাল দশ টাকা। এমন মজার রসদ কোথায় পাবেন, মেলায় ছাড়া।

মফস্বলের নিজস্ব চেহারার সাথে দিব্যি মিলে মিশে আছে এইসব মেলার চরিত্র। বড়ো বড়ো উনুনে টগবগিয়ে ফুটতে থাকা ঘুগনি। যার দু এক চামচ মুখে গেলেই নাকের জল , চোখের জল মিলে মিশে একাকার। হাইজিনের পরোয়া না করেই টপাটপ ফুচকার টক জলে ডুবে যাওয়া।

কখনো বন্দুক দিয়ে বেলুন ফাটিয়েছেন... কেমন উজ্জ্বল হয়ে যায় মুখগুলো, আমার এক বন্ধু একবার বলেছিল, যাদের ওপর খুব রাগ হবে, এক একটা বেলুনে তাদের মুখ বসিয়ে বন্দুক তাক করবি... আহা সে এক অপার শান্তি। রাগ হলে আমি এখনো করি, আপনারাও করবেন কি না ভেবে দেখতে পারেন; রাগ নাই কমুক মজার গ্যারান্টি ষোলো-আনা।

বোধহয় রথের মেলা; এতদিনে তেমন মনেও নেই, আমরা বন্ধুরা সব দল বেঁধে ঘুরে বেরাচ্ছি, একটি শিশু তার বাবা মায়ের হাত ধরে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। লক্ষ করলাম, শিশুটির মা বাবা অন্ধ। শিশুটিই যেন তাদের অন্ধের যষ্ঠি। আর তার চাইতেও অদ্ভুত যা মনে হল হাত পাততে ছেলেটির এতটুকু আগ্রহ নেই; হবার কথাও নয়। ছটফটে শিশুটির চোখ স্থির হয়ে আছে সামনের আইসক্রিম গাড়িটার দিকে... এক টাকা দিয়ে বিদায় দিলাম, আইসক্রিম দেবার তো প্রশ্নই নেই... এগিয়ে গেল ওরা, আবার অন্য কারো সামনে হাত....!

মেলা শেষে বাড়ি ফিরছি। দেখি শিশুটির হাতে একটা কাঠি আইসক্রিম, অন্য হাতে বেলুন আর হাওয়ায় উড়তে থাকা পতঙ্গা। মাঝে মাঝে অন্ধ মায়ের মুখেও গুঁজে দিচ্ছে নিজের মুখ থেকে…। চোখে মুখে কোথাও এতটুকু অতৃপ্তি কিংবা অপ্রাপ্তি নেই... এতটুকু অভিযোগ নেই বিশ্বের প্রতি... ।

কেন আমায় হাত পাততে হবে অন্যের সামনে? কেন কারোর গায়ে এতটুকু ছোঁয়া লাগলে দূরে ঠেলে সরিয়ে দেবে আমায়? কেন আমার খাবার নেই? কেন রাস্তায় থাকতে হবে আমায়? নাহ্ একটাও প্রশ্ন ছিলনা ওর সরল মুখে। ও যতক্ষন চেটেপুটে আইস্ক্রিম শেষ করল, আমিও চেটেপুটে নিলাম ওর অভিযোগ হীন প্রাপ্তির স্বর্গীয় দৃশ্যটা। সামান্য না পাওয়ায় বিচলিত মানুষ আমরা, সবেতেই অভিযোগ আর রাগের পারদ। ওই শিশুটির কাছে শিখেছিলাম অমন স্বর্গীয় হাসি যা পারিজাতের চেয়েও পবিত্র। দু: খের বুকে দাঁড়িয়ে মনে হয়, ইশ্ যদি অমন করে হাসতে পারতাম। অমন দেবতূল্য হাসি বোধহয় শিশুর মত ঈশ্বরের মুখেই মানায়।

প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি। ট্রেনের আসতে দেরি দেখে ঝালমুড়ি খেতে খেতে সময় মাপার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছি। হঠাৎ দেখি কৃশকায় একজন মানুষ প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে থাকা ছিঁড়ে যাওয়া মুড়ির প্যাকেট থেকে পরম যত্নে বাদাম বেছে বেছে খাচ্ছে...। মনটা এত খারাপ হয়ে গেল, তখুনি দৌঁড়ে গিয়ে এক প্যাকেট ঝালমুড়ি নিয়ে লোকটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম এটার থেকে খান; মাটি থেকে তুলছেন কেন?

শান্ত মানুষ টি যেন পলক ফেলতেই রুদ্রমূর্তি... ‘আমি চেয়েছি আপনার থেকে? দয়া দেখাতে এসেছেন। যান নিজের কাজে।’ অপমান আর লজ্জায় পেছনে সরে এসেছিলাম ।এত রাগ হয়েছিল, এই জন্যেই লোকের উপকার করতে নেই, মনে মনে গজগজ করে উঠেছিলাম। পরে ভেবে দেখেছিলাম সত্যিই তো দশ টাকা দিয়ে কি পেতে চেয়েছিলাম সেদিন। আত্মশ্লাঘা; আত্মতৃপ্তি? পারতাম পরপর সাতদিন ওই লোকটার খাবার ব্যবস্থা করতে? না কি মহৎ সাজার ইচ্ছে হয়েছিল?

আজ যখন খবরের কাগজের পাতায় বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা দেখি অমুক মহান ব্যক্তি বিরাট অঙ্কের টাকা দিয়েছে অমুক প্রতিষ্ঠানকে একটাই কথা আরো বেশি করে মনে হয়...! ‘তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান, গ্রহন করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়…’ রবি ঠাকুরের এই লেখা আজ যেন নতুন করে উপলব্ধি করতে পারি আবার।

উপরে